খুলনায় আদালতের প্রধান ফটকের সামনের সড়কে গুলিতে নিহত দুই যুবক ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ পলাশের সক্রিয় সহযোগী ছিলেন। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে আরেক ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ রনি চৌধুরী ওরফে ‘গ্রেনেড বাবুর’ সহযোগীরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারেন বলে ধারণা করছে পুলিশ।
আজ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আদালতে হাজিরা দিতে আসা হাসিব হাওলাদার (৪১) ও ফজলে রাব্বি রাজন (৩৭) নামের ওই দুই ব্যক্তিকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হাসিবের বাড়ি নগরের নতুনবাজার ওয়াপদা বেড়িবাঁধ রোডে (মিনারা গলি)। আর ফজলে রাব্বি রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসার বাগমারা আবদুর রবের মোড় এলাকার বাসিন্দা। তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধে ছয়টি করে মামলা আছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, সোনাডাঙ্গা থানার একটি অস্ত্র মামলায় হাজিরা দিতে ফজলে রাব্বি ও হাসিব মহানগর দায়রা জজ আদালতে যান। হাজিরা দিয়ে প্রধান ফটক থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছয় থেকে সাতজনের একটি দল ফজলে রাব্বির ঘাড়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ দেন। অপর একজন এসে তাঁর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করেন। একই সময় আরেক সন্ত্রাসী হাসিবকে গুলি করেন। তাঁরা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে কয়েকজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এ সময় আশপাশের মানুষ নিরাপদ স্থানে সরে যান। কিছুক্ষণ পর সন্ত্রাসীরা কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছোড়েন। এরপর তাঁরা বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ের দিকের সড়ক দিয়ে চলে যান। হাসিব ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান ফজলে রাব্বি।
নিহত হাসিবের এক প্রতিবেশী প্রথম আলোকে বলেন, হাসিব একসময় মাছ কেনাবেচা করতেন। সাত-আট মাস ধরে তিনি বাড়িতে থাকতেন না। দুপুরে আদালতের সামনে গুলি খেয়ে মারা গেলে পরিচিত এক ইজিবাইকচালক তাঁর লাশ নতুন বাজারে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে লাশ স্থানীয় মসজিদে নেওয়া হয়। পরে পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য লাশ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যায়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজন বলেন, ঘটনার সময় তিনি সার্কিট হাইসের মূল ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ শব্দ শুনতে পান। প্রথমে ভেবেছিলেন, টায়ার ফেটে গেছে। পরে দেখতে পান, রক্তাক্ত হয়ে দুজন পড়ে আছেন। কয়েকজন লোক দৌড়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ের দিকের রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আদালত চত্বরের সীমানাপ্রাচীরের গা ঘেঁষে এক যুবক পড়ে আছেন। আরেক যুবক লম্বা ছুরি দিয়ে তাঁকে কোপাচ্ছেন। এ সময় পিস্তল হাতে আরও কয়েকজন যুবক আশপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর পূর্ব পাশের সড়ক দিয়ে তাঁরা দল বেঁধে চলে যান।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শামীম হাসান বলেন, প্রথমে রাজনকে ও পরে হাসিবের লাশ হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি ও কোপের আঘাত ছিল।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৩০ মার্চ সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। এ সময় শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ পলাশসহ ১১ জনকে আটক করা হয়। তাঁদের মধ্যে ফজলে রাব্বিও ছিলেন। উদ্ধার করা হয় পিস্তল, শটগান, কাটা বন্দুক, গুলি, কুড়াল, চাপাতিসহ দেশি অস্ত্র। ওই ঘটনায় হওয়া অস্ত্র মামলায় ফজলে রাব্বিকে ৬ নম্বর এবং হাসিব হাওলাদারকে ১১ নম্বর আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ওই মামলায় হাজিরা দিতে আজ তাঁরা আদালতে গিয়েছিলেন।
পুলিশের তথ্যমতে, হাসিব হাওলাদারের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে সোনাডাঙ্গা থানায় এবং ২০১৮ সালে লবণচরা থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি, ২০২৩ সালে সদর থানায় হত্যাচেষ্টা, ২০২৫ সালে সোনাডাঙ্গা থানায় অস্ত্র আইনে, সরকারি দায়িত্বপালনে বাধা ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইনে মামলা আছে। ফজলে রাব্বির বিরুদ্ধে রূপসা থানায় ২০১৬ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে, ২০২৫ সালে সোনাডাঙ্গা থানায় অস্ত্র আইনে, আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার), দুটি হত্যাসহ মোট ছয়টি মামলা আছে।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী রনি চৌধুরী ওরফে ‘গ্রেনেড বাবু’ গ্রুপের সঙ্গে পলাশ গ্রুপের দ্বন্দ্ব আছে। কয়েক দিন আগে কারাগারের ভেতরেও দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পুরোনো দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কি না, তদন্ত করা হচ্ছে।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছি। এ ছাড়া ঘটনাস্থল ঘিরে রাখা হয়েছে। সিআইডি, গোয়েন্দা সংস্থা ও পিবিআইয়ের টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। নিহত দুজন শীর্ষ সন্ত্রাসী পলাশের দলের লোক। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী রনি চৌধুরী ওরফে গ্রেনেড বাবুর সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। তদন্তের পর বিষয়টি পরিষ্কার হবে।’