সম্ভাবনার ঝিলিক দেখানো সমতলের চায়ে আছে নানা সংকট

পঞ্চগড় সদর উপজেলার একটি চা বাগান থেকে কাঁচা চা পাতা সংগ্রহ করছেন শ্রমিকেরা। ছবিটি সম্প্রতি তোলাছবি : রাজিউর রহমান

সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের পর সর্ব উত্তরের পাঁচ জেলা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। চা উৎপাদনের দিক থেকে সর্বশেষ গত দুই অর্থবছরে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে উত্তরাঞ্চল। সমতলের চা উৎপাদনে প্রতিবছর উত্তরাঞ্চল একের পর এক রেকর্ড করছে। সমতলের চা ঘিরে তৈরি হয়েছে অপার সম্ভাবনা।

তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি চাষিরা কাঁচা পাতার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় সংকট দেখা দিচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন ক্ষুদ্র চাষিরা। এ অবস্থায় সমতলের চা–শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সংকট নিরসনের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এমতাবস্থায় আজ রোববার জাতীয় চা দিবস পালিত হচ্ছে।

চাষিদের অভিযোগ, ভরা মৌসুমে কারখানাগুলো সিন্ডিকেট করে চাষিদের কাঁচা চা–পাতার নায্যমূল্য না দিয়ে ঠকাচ্ছে। এতে অনেকে চা চাষ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন। এমনকি কেউ কেউ ক্ষোভে-দুঃখে চা–বাগান বাদ দিয়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে উত্তরের পাঁচ জেলা—পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের সমতল ভূমিতে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৬ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের মৌসুমের (২০২১) চেয়ে ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি বেশি। উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমিতে ২০১৭ সালে ৫৪ লাখ ৪৬ হাজার কেজি চা উৎপন্ন হয়। এরপর ২০১৮ সালে ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি, ২০১৯ সালে ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার কেজি, ২০২০ সালে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি, ২০২১ সালে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে।

চা বোর্ডের তথ্যমতে, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে গিয়ে সমতলে চা চাষের সম্ভাবনার কথা বলেন। এরপর পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের প্রচেষ্টায় পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিসরে পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরু হয়। প্রথম দিকে টবে ও পরে পতিত জমিতে চা চাষ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় চায়ের বাগান গড়ে তোলে। ২০০৭ সালে লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও, ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলায় নিবন্ধিত ৯টি ও অনিবন্ধিত ২১টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের বেশি) আছে। এ ছাড়া ২ হাজার ৫৩টি নিবন্ধিত ও ৬ হাজার ৩০২টি অনিবন্ধিত ছোট চা-বাগান (২৫ একরের কম) আছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার ৭৯ একর জমিতে চা হচ্ছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র চা–চাষি আছেন ৮ হাজার ৩৫৫ জন।

নিলাম বাজারে তৈরি চায়ের দাম কমের কথা বলে চাষিদের থেকে কম দামে পাতা কিনছে কারাখানাগুলো। অথচ আমরা শুনেছি, তাঁরা ভালো মানের চা কালোবাজারে বিক্রি করে খারাপ চা নিলাম বাজারে তোলেন।
সায়েদ আলী, সভাপতি, পঞ্চগড় জেলা চা–চাষি অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি

সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলে এখন পর্যন্ত অনুমোদিত ৫২টি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা আছে। এর মধ্যে পঞ্চগড়ে ২৫টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি কারখানা সচল। কারখানাগুলো চাষিদের কাছ থেকে সবুজ চা-পাতা কিনে চা তৈরি (মেড টি) করে। এরপর সেই চা চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলের নিলাম বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন কারখানার মালিকেরা। চলতি মাসে পঞ্চগড়ে চায়ের তৃতীয় নিলাম বাজার চালুর কথা আছে। বাজারটি চালু হলে সমতলের চায়ের সুদিন ফিরবে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

চা–চাষিরা জানান, প্রতিবছর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চা উৎপাদনের মৌসুম। চলতি বছর জেলা প্রশাসনের চা–পাতা মূল্য নির্ধারণ কমিটি প্রতি কেজি কাঁচা চা–পাতার দাম ১৮ টাকা নির্ধারণ করলেও কারখানাগুলো কিনছে ১৪ থেকে ১৬ টাকা দরে। সার–কীটনাশকের মূল্যবৃদ্ধি ও খরায় বাড়তি সেচের কারণে প্রতি কেজি কাঁচা চা–পাতায় উৎপাদন খরচ হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকা। সময়মতো শ্রমিক না পাওয়ায় ৪০–৪৫ দিন পর বাগান থেকে পাতা তুলতে হচ্ছে। শ্রমিকদের ৩ টাকা দিলেও উৎপাদন খরচ ১৫ টাকা পড়ে যাচ্ছে। এরপরও কারখানাগুলো নানা অজুহাতে (ভেজা, নিম্নমান) কাঁচা চা–পাতার প্রকৃত ওজন থেকে ২০–৩০ শতাংশ কেটে রাখে। একদিকে দাম কম, অন্যদিকে ওজনে ঠকে লোকসানে পড়ছেন চাষিরা।

পঞ্চগড় : পঞ্চগড় সদর উপজেলার একটি চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় তৈরি হচ্ছে চা। ছবিটি সম্প্রতি তোলা
ছবি : রাজিউর রহমান।

চাষিদের অভিযোগ, ভরা মৌসুমে কারখানাগুলো সিন্ডিকেট করে চাষিদের কাঁচা চা–পাতার নায্যমূল্য না দিয়ে ঠকাচ্ছে। এতে অনেকে চা চাষ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন। এমনকি কেউ কেউ ক্ষোভে-দুঃখে চা–বাগান বাদ দিয়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা করছেন। তবে কারখানাগুলোর মালিকপক্ষের দাবি, চাষিরা কাস্তে দিয়ে কেটে বড় বড় চা–পাতা কারখানায় সরবরাহ করেন। এতে মানসম্মত চা উৎপাদিত না হওয়ায় নিলাম বাজারে তাঁরা তৈরি চায়ের দাম কম পাচ্ছেন। এ জন্য তাঁরা কাঁচা চা–পাতা বেশি দাম দিয়ে কিনতে পারছেন না।

পঞ্চগড় জেলা চা–চাষি অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি সায়েদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমরা চা চাষ শুরু করেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে আমরা ক্ষুদ্র চাষিরা কাঁচা চা–পাতার ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশায় ভুগছি। নিলাম বাজারে তৈরি চায়ের দাম কমের কথা বলে চাষিদের থেকে কম দামে পাতা কিনছে কারাখানাগুলো। অথচ আমরা শুনেছি, তাঁরা ভালো মানের চা কালোবাজারে বিক্রি করে খারাপ চা নিলাম বাজারে তোলেন। আমাদের দাবি, পঞ্চগড়ে সরকারিভাবে একটি চা কারখানা স্থাপন করা হোক। সেই সঙ্গে সমতলের চা–শিল্প টিকিয়ে রাখতে স্থায়ীভাবে চায়ের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হোক।’

আরও পড়ুন

পঞ্চগড়ের নর্থ বেঙ্গল টি ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চাষিদের কাঁচা চা–পাতা চয়ন যদি মানসম্মত হয়, তাহলে তৈরি চা-ও মানসম্মত হবে। বর্তমানে নিলাম বাজারে পঞ্চগড়ে তৈরি চায়ের দাম কিছুটা কম। নিলাম বাজারে না তুলে কেউ কেউ কালোবাজারে তৈরি চা বিক্রি করছেন বলে আমরা শুনেছি। প্রশাসন, চা বোর্ড ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সজাগ থাকলে হয়তো এ সমস্যা নিরসন করা সম্ভব।

বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পঞ্চগড়সহ পাশের জেলাগুলোর সমতল ভূমি চা চাষের সম্ভাবনাময় এলাকা। তাঁরা চাষিদের বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে চা চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন। উত্তরাঞ্চলে চা চষের পরিধি বাড়ছে। বর্তমানের সংকট নিরসনে সমতলের চায়ের গুণগত মানোন্নয়নের চেষ্টা চলছে। এ জন্য চাষিদের চা–পাতার কাঁচি (কাস্তে) দিয়ে কাটা থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি কারখানাগুলোকে ছোট পাতা ক্রয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিক–সংকট নিরসনে প্ল্যাকিং মেশিন বরাদ্দের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পঞ্চগড়ে চায়ের নিলাম বাজারের কার্যক্রম শুরু হলে শিগগিরই সংকট দূর হবে বলে তিনি জানান।