অবসরেও আলো ছড়াচ্ছেন তাঁরা

সবার বয়স ৬০ বছরের বেশি। বয়স বেশি হলেও নানা ধরনের সামাজিক–সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাঁরা। করছেন জনসেবামূলক কাজ।

চুয়াডাঙ্গার প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সদস্যরা তাঁদের কার্যালয়ে আলোচনা সভা করছেন। গত বৃহস্পতিবার তোলা ছবি
প্রথম আলো

কর্মজীবনে কেউ ছিলেন অধ্যাপক, কেউবা স্কুলশিক্ষক আবার কেউ কেউ ব্যাংক, স্বাস্থ্য, কৃষি ও রেল বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারী। অবসর নিয়েছেন অনেক আগে। সাধারণত এ বয়সে অনেকেই বাড়িতে অলস সময় কাটান। কিন্তু তাঁদের কথা আলাদা। অবসর এই জীবন উপভোগ্য করে তুলতে তাঁরা সপ্তাহে ছয় দিন একটি স্থানে মিলিত হন। আড্ডা দেন। করেন জনসেবামূলক কাজ। চিত্তবিনোদন, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নানা ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর নেওয়া এসব প্রবীণ ব্যক্তি কাজগুলো সুন্দরভাবে করার জন্য গড়ে তুলেছেন একটি সংগঠন। নাম দেওয়া হয়েছে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ। সংঘের সদস্যরা কর্ম ও ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনদের জন্য ইতিবাচক ও শিক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে চলেছেন।

প্রবীণ হিতৈষী সংঘের কার্যালয় চুয়াডাঙ্গা শহরের গুলশানপাড়ায়। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় সংঘের কার্যালয়ে হাজির হতেই দেখা গেল ফুরফুরে মেজাজে আছেন সবাই। বয়সের কথা ভুলে গিয়ে কেউ গুনগুন করে গান ধরেছেন, কেউ প্রাণ খুলে আড্ডা দিচ্ছেন, কবিতা পাঠ করছেন। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কেউ কেউ প্রাণখুলে হাসছেন। আবার কেউ কেউ সংবাদপত্র বা বইয়ের পাতায় রয়েছেন নিমগ্ন।

এ সময় কথা হয় স্বাস্থ্য বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রশিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন। সন্তানদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে থাকলে একাকিত্বে ভুগি। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিনই এখানে ছুটে আসি। একাকিত্ব ভুলে কিছু সময়ের জন্য অন্য জগতে ফিরে যাই।’

চুয়াডাঙ্গা শহরের সদর হাসপাতালপাড়ার বাসিন্দা হামিদুল হক মুন্সী ১৯৮৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন। অধ্যক্ষের পদে থেকেও শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ধারাবাহিকতা রেখেছেন কর্মজীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। অবসরেও আলো ছড়াচ্ছেন সমানতালে। মেধা, শ্রম ও সৃষ্টিশীলতার কারণে অসংখ্যবার সেরা শিক্ষকের মর্যাদা পাওয়া হামিদুল বর্তমানে মাথাভাঙ্গা নদী বাঁচাও আন্দোলন ও শিক্ষকদের সংগঠন শিক্ষাবিদ ফোরামের সভাপতি। প্রবীণ হিতৈষী সংঘের উপদেষ্টা। সাহিত্যাঙ্গনেও রয়েছে বেশ দাপট। তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ৪৯টি বই লিখেছেন। লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন ১০০টির বেশি।

হামিদুল বলেন, ‘শিক্ষকের অবসর বলে আসলেই কিছু নেই। তাঁদের কর্তব্যই হচ্ছে জীবনব্যাপী শিক্ষাদান। সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক বা প্রতিষ্ঠানের বাইরে। তবে শিক্ষাদানে এখনো আনন্দ পাই। বেশ ভালো লাগে। তাই চাকরি জীবনের অবসরে এসেও ছুটে চলি এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, নদীসহ প্রকৃতি রক্ষায় ভূমিকা এবং মাদক ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে কথা বলি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।’

দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে উপস্থিত হয়ে মাদক, বাল্যবিবাহ, প্রকৃতি রক্ষায় ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ প্রদান ও শিক্ষার্থীদের ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন হামিদুল হক। তিনি এই কাজের গুরত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা মানুষ হলেই আমার শ্রম সার্থক। এ ছাড়া প্রবীণ হিতৈষী সংঘের হয়ে প্রবীণদের পাশাপাশি সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কল্যাণে কাজ করে থাকি। উৎফুল্ল মন নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা।’

চুয়াডাঙ্গা শহরের এম এ বারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এ কে এম আলী আখতার। সংঘের সভাপতির দায়িত্বে ছয় বছর। আখতার জানালেন, সরকারি-বেসরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সমাজের মূলধারা থেকে চাকরিজীবীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। অনেকেই একাকিত্বে ভোগেন। একাকিত্ব দূর করে এসব মানুষের জীবনকে দীর্ঘ করা যায় কি না, সেই চিন্তায় ২০১৬ সালে চুয়াডাঙ্গায় প্রবীণ হিতৈষী সংঘের যাত্রা। তিনি বলেন, ‘যাঁরা আইসোলেটেড হয়ে গেছেন, এক জায়গায় বসে তাঁদেরকে নিয়ে কাজ করি। যাতে তাঁদের ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কিছুটা সময় ভালোভাবে কাটাতে পারেন।