‘আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি, নিঃস্ব হয়ে গেছি’

চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ট্রেলারের ধাক্কায় নিহত শিশু নাজমুল সাকিবছবি : সংগৃহীত

‘ছেলেটার জামাকাপড়, বইখাতা, জুতাজোড়া পড়ে আছে বাসায়। সব আছে, কিন্তু ছেলেটা নেই। আর কখনো ফিরবে না। বুকে জড়িয়ে ধরবে না।’ চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গায় লরির ধাক্কায় নিহত চার বছরের শিশু নাজমুস সাকিবের বাবা মো. আলমগীর হোসেন এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁর গলা শুকিয়ে আসে। তবু নিজেকে সামলে প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।’

গত শুক্রবার রাতে নগরের পতেঙ্গা এলাকার প্রজাপতি পার্কের পাশে নেভাল এলাকায় ঘুরতে গিয়েছিলেন মো. আলমগীর হোসেনের স্ত্রী নুসরাত জাহান (২৫), বড় ছেলে আল ইমরান (৯), ছোট ছেলে নাজমুস সাকিব (৪)। আরও ছিলেন নুসরাত জাহানের ভাই আসাদুজ্জামান সানি (২০) ও ভাইয়ের স্ত্রী তাসপিয়া আক্তার (১৮)। সেই রাতে ফুটপাতে হাঁটছিলেন তাঁরা। রাত আটটার দিকে হঠাৎ বেপরোয়া একটি প্রাইম মুভার ট্রেলার এই পাঁচজনকে ধাক্কা দেয়। এরপর ট্রেলারটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রজাপতি পার্কের পাশের একটি পুকুরে পড়ে যায়। ছিটকে গিয়ে প্রাণে বাঁচেন আলমগীরের স্ত্রী নুসরাত জাহান ও বড় ছেলে আল ইমরান। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মধ্যরাতে মারা যান আসাদুজ্জামান ও তাসপিয়া আক্তার। দুর্ঘটনার চার ঘণ্টা পর রাত ১১টার দিকে পুকুরের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় নাজমুস সাকিবের মরদেহ। ট্রেলার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নাজমুসসহ পুকুরে পড়েছিল।

দুর্ঘটনার ৩০ মিনিট পর ঘটনাস্থলে পৌঁছান মো. আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি আমার স্ত্রী নুসরাত ছোট ছেলের জন্য কান্নাকাটি করছে। ওই সময় তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপর সেখান থেকে হাসপাতালে যাই। আহতদের খুঁজে বের করি। রাত ১১টার কিছু পরে আসাদুজ্জামান ও রাত ১২টার দিকে তাসপিয়ার মৃত্যু হয়। এরপর ছোট ছেলের লাশ উদ্ধারের খবর আসে।’

মো. আলমগীর হোসেন পরিবার নিয়ে থাকতেন চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গায়। তাঁদের সবার বাড়ি খুলনায়। মাস দুয়েক আগে আলমগীরের শ্যালক আসাদুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রী তাসপিয়া আক্তার কাজের সন্ধানে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। পরে স্থানীয় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি হয় আসাদুজ্জামানের। মো. আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব তো শেষ। আমাদের আর কিছুই রইল না। আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি। নিঃস্ব হয়ে গেছি। পরিবার তছনছ হয়ে গেছে।’

মো. আলমগীর হোসেন জানান, তিনিও চট্টগ্রাম নগরের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। ২০ হাজার টাকা বেতন পান। বড় ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। ছোট ছেলে প্লেতে ভর্তি হয়েছিল। দুই ছেলেকে নিয়েই অনেক স্বপ্ন ছিল। পড়াশোনা করে বড় জায়গায় যাবে, এমনটাই চাওয়া ছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।

ছোট ছেলের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না মা-বাবা। বাবা আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোট ছেলেটাকে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়েছিল। বৃহস্পতিবারও সে ক্লাসে গেছে। পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু পরদিনই সব শেষ। অথচ তাকে অনেক প্রার্থনার মাধ্যমে পেয়েছিলাম আমরা।’

মো. আলমগীর হোসেনের স্ত্রী নুসরাত জাহানরা চার বোন। তাঁদের একমাত্র ভাই ছিলেন আসাদুজ্জামান সানি। মাস ছয়েক আগে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। আলমগীর বলেন, ‘এ পরিবারও একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল। কাকে কে সান্ত্বনা দেবে এখন? সবাই বিমর্ষ।’

সেদিন রাতে ট্রেলারটি চালাচ্ছিলেন একজন হেলপার। তাঁর নাম কামাল হোসেন। তাঁর কোনো লাইসেন্সও ছিল না। বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কবিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, কামাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।