৫০ টাকায় মিলছে মাছ-মাংস ১০ টাকায় চিনি, তেল

রংপুর সদরের চন্দনপাট ইউপির বালাচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সাধ্যের বাজার
ছবি: প্রথম আলো

৫০ টাকায় মাংস-মাছ আর ১০ টাকার বিনিময়ে পৃথকভাবে তেল, চিনি, খেজুর, মসুর ডাল ও ছোলা কেনা যাবে। এমনই এক বাজারের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সাধ্যের বাজার’। মূলত এটি একটি দোকান। ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বাজার সাড়া ফেলেছে। নিম্ন ও স্বল্প আয়ের লোকজন সেখানে গিয়ে সাধ্যের মধ্যে ওই খাদ্যপণ্যগুলো কিনতে পারছেন।

পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে ওই বাজারটি দেওয়া হয়েছে, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা সীমান্তের পাশে রংপুর সদরের বালাচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। বাজারের মূল উদ্যোক্তা হচ্ছেন কলেজশিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, বালাচড়া এলাকার আরও আট কলেজ শিক্ষার্থী ও তিন ব্যবসায়ী। গত শুক্রবার প্রথম রমজানে ওই বাজারের উদ্বোধন করা হয়। বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সাধ্যের বাজারে বেচাকেনা চলে।

রোববার সন্ধ্যার আগে দেখা যায়, ওই মাঠে শামিয়ানা টানিয়ে বড় আকারে দোকানটি দেওয়া হয়েছে। খাদ্যপণ্যের মধ্যে রয়েছে, মাছ, মাংস, ছোলা, তেল, চিনি, খেজুর ও ডাল। নিম্ন আয়ের লোকজন সাধ্য অনুযায়ী তা অনায়াসে কিনতে পারছেন।

দোকানে কিনতে আসা শিবপুর বালাচওড়া গ্রামের দিনমজুর জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘হাটোত গেইলে ১০০ টাকার নিচোত মাছ পাওয়া যায় না। এ্যাটেকোনা ৫০ টাকাত মাছ, ২০ টাকাত ডাইল আর ১০ টাকাত তেল কিননু। ছাওয়াগুলার (উদ্যোক্তারা) আল্লাহ ভালো করুক। হামাক গরিব মাইসোক রোজাত কম দামোত জিনিসপত্র দেওছে।’

জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে কথা শেষ না হতেই পলিথিনের ব্যাগে ব্রয়লার মুরগির কয়েক টুকরা মাংসের দিকে বারবার তাকিয়ে মাঠ ছেড়ে বাড়ির দিকে ছুটছিলেন শিবপুর বালাচওড়ার হাফিজার রহমান। তিনি জানান, তিন ছেলে, মেয়ে তাঁর। সর্বশেষ ছয় মাস আগে মাংস খেয়েছেন। দৈনিক আয় ৩০০-৪০০ টাকা হলেও আয়ের ১০০ টাকা ঋণের কিস্তি বাবদ রাখতে হয়। বাকি টাকায় পাঁচ সদস্যের সংসারে চাল–ডাল কিনতেই শেষ হয়। তাই মাছ–মাংস কেনার সাধ্য হয় না। কিন্তু আজ (রোববার) ৭৫ টাকায় ২৫০ গ্রাম ব্রয়লার মুরগির মাংস কিনেছেন। এই সাধ্যের বাজার থেকে রমজানজুড়ে নিজের সাধ্যমতো মাছ–মাংস কিনে খেতে পারব।

বদরগঞ্জের গোপালপুর গ্রামের স্বামীহারা ইসমত আরা বেগম (৩৫) বলেন, ‘এই দোকানটা (সাধ্যের বাজার) দিয়া হামার খুব উপকার হইছে। এ্যাটেকোনা ১০ টাকা থাকি খরচ কিনা যায়। যেঙ্কা টাকা, সেঙ্কা খরচ পাওয়া যায়। এইটা বড় সুবিধা।’  

শুধু জয়নাল আবেদীন ও হাফিজারই নয়; রংপুর সদরের চন্দনপাট ইউনিয়নের হরিপুর, বৈকুণ্ঠপুর ও বদরগঞ্জের গোপালপুর ইউনিয়নের বালাচওড়া, শিবপুর, হল্লাইপাড়া, কুঠিপাড়া, দক্ষিণটারী, ছোট শিবপুর, বড় শিবপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের নিম্ন¤ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মুখে ‘সাধ্যের বাজার’ হাসি ফুটিয়েছে।

কথা হলে সাধ্যের বাজারের উদ্যোক্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, শবে বরাতের দিন তিনি স্থানীয় শ্যামপুরহাটে বাজার করতে গেলে ব্রয়লার মুরগির দোকানে দেখতে পান একজন ভিক্ষুক সেখানে ৫০ টাকার মাংস চাইছেন। কিন্তু দোকানি তাঁকে মাংস না দিয়ে ফিরিয়ে দেন। বিষয়টি তিনি এলাকায় ফিরে বন্ধুদের জানান। সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা রমজানে এমন একটি বাজার করবেন, যাতে ১০ টাকা থেকে শুরু করে মানুষ তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্যপণ্য কিনতে পারেন। এরই ধারাবাহিকতায় সাধ্যের বাজার নামে দোকানটি দেওয়া হয়েছে। সবাই মিলে তাঁরা মূলধন বিনিয়োগ করেছেন। পাইকারি দরের সঙ্গে পরিবহন খরচ যোগ করে খাদ্যপণ্য সেখানে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ওই দোকান থেকে দেড় শতাধিক মানুষ খাদ্যপণ্য কিনছেন বলে জানান উদ্যোক্তারা।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘গত রমজানের চেয়ে এবারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দ্বিগুণ। নিম্ন আয়ের মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। পাঁচ সদস্যের একটা দিনমজুর পরিবার সবজি–ভাত খেতে হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে মাছ–মাংস কেনাটা যেন স্বপ্ন। তাই আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি। মানুষের সাড়াও পাচ্ছি। আমরা লাভ করছি না। চেষ্টা করছি দোকানের মাধ্যমে গরিব মানুষের উপকার করার।’

সাধ্যের বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা পলাশ চন্দ্র দাস বলেন, ‘খাদ্যপণ্য আমরা কেনা দামে বিক্রি করছি। সিলভার বিগহেড মাছ কেজি ২০০ আর ব্রয়লার মুরগির কাটা মাংস ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। পযার্য়ক্রমে দোকানে আরও পণ্য বাড়ানো হবে। প্রতিদিন রংপুর শহরের পাইকারি বাজার থেকে এসব পণ্য কিনে আনা হয়। ২৭ রমজান পর্যন্ত যদি কোনো মুনাফা দোকান থেকে পাই, তবে তা ঈদের আগে দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে।

চন্দনপাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) আমিনুর রহমান বলেন, গ্রামের তরুণ প্রজন্ম যে ভালো কিছু করছে, তার প্রমাণ ‘সাধ্যের বাজার’। তাদের এ উদ্যোগের জন্য গ্রামের দিনমজুর, নিম্ন আয়ের মানুষ তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটা করতে পারছেন। এ উদ্যোগ অবশ্যই অনুকরণীয়।