সিডরের স্মৃতি বাকরুদ্ধ করে মোস্তফাদের

মোস্তফা শেখ
ছবি: প্রথম আলো

বলেশ্বর নদের পাড়ে ছিল মোস্তফা শেখের জমি ও বসতবাড়ি। মা–বাবা, পাঁচ ভাইবোন, দাদি, বোনের এক ছেলেসহ মোট নয়জন ছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্য। কাঠমিস্ত্রি বাবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হলেও ভালোই চলছিল তাঁদের জীবন। কিন্তু ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরে সব হারান মোস্তফা।

মোস্তফার বাবার মামাতো বোন কমলা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই রম যে দুর্যোগ আইবে, কোনো দিন আমরা কল্পনাও হরি নাই। হেদিন হন্দার পর আস্তে আস্তে বাতাস আর বৃষ্টি বাড়িতে থাহে। আমরা হগলে বাড়িতই ছিলাম। রাইত হতি হতি বাতাসও বাড়ে। একটা গাছ আই আমার ঘর প্যাঁচায় পড়ছে। হ্যার পর আমরা সবাই ঘুরদে বাইর অই। নদীতে তহন হঠাৎ করেই পানি বাড়ছে। তা দেহে সবাই মিলে বাঁধে উঠতে রওনা হই।’

মুহূর্তেই বড় ঢেউ এসে তলিয়ে দেয় তাঁদের। তখন একটা নৌকায় উঠে বাঁচতে চেষ্টা করেন সবাই। তীব্র স্রোতে উল্টে যায় সেই নৌকা। ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবাইকে। ভাসতে ভাসতে একটা গাছের ডাল আঁকড়ে বেঁচে যান মোস্তফা শেখ। ২০০৭ সালে মোস্তফা শেখের বয়স ১৪ বছর। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সেই রাতে মা-বাবাসহ পরিবারের ৮ সদস্যকে হারান তিনি। সেই থেকে শুরু হলো মোস্তফার একলা চলা। মোস্তফা বলেন, নদীতে মাছ ধরে বা দিনমজুরের কাজ করে চলে তাঁর জীবন। সিডরের সেই স্মৃতি মনে হলে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

মোস্তফার বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামে। বলেশ্বর নদের পাড়ে বেড়িবাঁধের বাইরে ছিল তাঁদের ঘর। নদে পানি বাড়ায় মুহূর্তেই বেড়িবাঁধের কয়েক ফুট ওপর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাঁদের।

সরকারি হিসাবে, প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে বাগেরহাটে ৯০৮ জন মারা যান। আহত হন কয়েক হাজার মানুষ। সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় ৬৩ হাজার ৬০০ বাড়িঘর। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় ৫ কিলোমিটার পাকা সড়ক, কাঁচা সড়ক ধ্বংস হয় প্রায় ৫০ কিলোমিটার। আর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার বাঁধ। মারা যায় ১৭ হাজার ৪২৩টি গবাদিপশু। বিনষ্ট হয় ১২ হাজার হেক্টর খেতের ফসল ও ৮ হাজার ৮৮৯ হেক্টর চিংড়িঘের।

সিডরের সেই ভয়াবহ স্মৃতি আজও তাড়া করে ফেরে উপকূলবাসীকে। সে রাতে দুই বোনের সঙ্গে চট্টগ্রামে ছিলেন শরণখোলার শফিকুল ইসলাম পঞ্চায়েত। বাড়িতে মা–বাবা, ছোট ভাই, দুই ভাগনি আর ভাগনে ছিলেন। ঝড়ের পরের দিন অনেক কষ্টে শরণখোলায় ফিরে আসেন তাঁরা। বাড়িতে থাকা সাতজনের মধ্যে একমাত্র বেঁচে যান ছোট ভাই মো. সোহাগ। স্বজন হারানোর কথা মনে হলে আজও নির্বাক হয়ে যান সোহাগ।

সোহাগ বলেন, ২০০৭ সালে তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন। সন্ধ্যার পরেই শুরু হয় বাতাস। রাত ৯টার দিকে মানুষের ডাক–চিৎকারে তাঁরা বাড়ি থেকে বের হন। প্রথমে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ঘরের মধ্যে পানি আসতে শুরু করলে আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হন। হঠাৎ পানির তোড়ে পরিবারের থেকে দলছুট হয়ে যান তিনি। স্রোত তাঁকে বড় একটি গাছের আছড়ে ফেলে। পরে সেই গাছ ধরেই প্রাণে বেঁচে যান। পরের  দিন সকালে পরিবারের কাউকে খুঁজে পাননি। চার দিন পর মায়ের লাশ, আর ১০ দিন পরে বাবার লাশ খুঁজে পান।

সিডরের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বারবারই বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন সোহাগ। ভয়ংকর সেই স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে সোহাগ-মোস্তফাসহ অনেক উপকূলবাসীকে। সিডরের আঘাত হানার অন্যতম স্থল ছিল শরণখোলার সাউথখালী। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে বেশির ভাগ ছিল শিশু। একই সঙ্গে স্বজন হারিয়ে অনেক শিশুকে বরণ করে নিতে হয় অসহায় জীবন। হারাতে হয় তাদের সোনালি শৈশব, কৈশোর ও স্বাভাবিক জীবন।