নতুন করে পাঁচটি পাহাড় কাটবে সিডিএ

সড়ক নির্মাণের জন্য খাড়াভাবে কাটা হয় পাহাড়। তাই প্রায় সময় সড়কের ওপর ধসে পড়ছে পাহাড়ের মাটি। সম্প্রতি ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক সড়কের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের স্থায়ী ক্যাম্পাস এলাকায়ছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত নতুন সড়ক নির্মাণে একে একে কাটা হয়েছিল ১৬টি পাহাড়। ছয় কিলোমিটার সড়ক করতে গিয়ে পাঁচ থেকে সাত বছর আগে পাহাড়গুলো কেটেছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। খাড়াভাবে কাটায় পাহাড় ধসে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এখন ‘ঝুঁকি’ এড়াতে অন্তত পাঁচটি পাহাড় আবারও কাটতে চায় সিডিএ। এর সব প্রস্তুতিও প্রায় সম্পন্ন করেছে সংস্থাটি।

চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামীর শেরশাহ বাংলাবাজার থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার সড়কটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫৩ কোটি টাকা। ছয় দফা সময় বৃদ্ধি করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি বছরের জুনে। অবশ্য সড়কের মূল কাজ শেষ হওয়ায় ২০২০-এর মাঝামাঝি সময়ে যান চলাচল শুরু হয়। এখন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন করে পাহাড় কাটার কাজ শেষ করতে চায় সিডিএ।

কাটা হবে পাঁচ পাহাড়
নতুন করে অন্তত পাঁচটি পাহাড় কাটা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিডিএর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের স্থায়ী ক্যাম্পাস-সংলগ্ন পাহাড়গুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিবছর বর্ষার সময় পাহাড়গুলো থেকে মাটি ধসে সড়কের ওপর চলে আসে। এখনো ফুটপাত ও সড়কের কিছু অংশে পাহাড় ধসের মাটি রয়ে গেছে।

পাহাড়ের সংখ্যা নির্ধারণ করা হলেও পাহাড় থেকে কী পরিমাণ মাটি কাটা হবে এবং কেটে ফেলার পর পাহাড় সংরক্ষণে কত টাকা ব্যয় হবে, তা স্পষ্ট করে বলছেন না প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএর কর্মকর্তারা। সিডিএর এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কেউ এই বিষয়ে কথা বলছেন না।

তবে প্রকল্পসংক্রান্ত নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, এই সড়ক নির্মাণে ১২ লাখ ঘনমিটার পাহাড় কাটতে হবে। ইতিমধ্যে সাত লাখ ঘনমিটার পাহাড় কেটে ফেলেছে সিডিএ। অর্থাৎ নতুন করে আরও পাঁচ লাখ ঘনমিটার পাহাড় কাটতে হতে পারে। তবে এটি কম-বেশি হতে পারে। আর পাহাড় কাটার পর তা সংরক্ষণে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ, জিও ব্যাগসহ সুরক্ষা কাজে অন্তত চার কোটি কাটা ব্যয় হতে পারে।

এর আগে অনুমোদনের চেয়ে বেশি পাহাড় কাটায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। অবশ্য পরে আবেদন করলে জরিমানা ৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে এখনো জরিমানার সে টাকা পরিশোধ করেনি সিডিএ। আবারও আবেদন করেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পাহাড় কাটায় এর আগে ২০১৭ সালেও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জরুরি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে বেশ কিছু শর্তের বিনিময়ে সিডিএকে আড়াই লাখ ঘনমিটার পাহাড় কাটার অনুমতি দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু কাটা হয়েছিল ৭ লাখ ঘনমিটার পাহাড়।

অনুমোদনের চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণ পাহাড় কাটা হলেও সিডিএ ঝুঁকি এড়ানো এবং জীববৈচিত্র্যের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি বলে অভিযোগ। খাড়াভাবে পাহাড় কাটায় তা পরবর্তী সময়ে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। সড়ক নির্মাণের জন্য পাহাড় কাটা হলেও উল্টো পাহাড় ধসের কারণে সড়ক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে। অতীতে বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে মাটি সড়কে চলে আসায় কিছু কিছু অংশে যান চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে।

সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আসাদ বিন আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, যতগুলো পাহাড় কাটা হয়েছে তার মধ্যে পাঁচটি পাহাড় কাটতে হবে। পাহাড়গুলো ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য নকশাও প্রণয়ন করা হয়েছে।

ফেব্রুয়ারিতে শুরু হবে পাহাড় কাটা
ঝুঁকিতে থাকা পাহাড়গুলো রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের আপিল কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছিল। সে সুপারিশ অনুযায়ী গত বছর পাহাড় রক্ষায় পাহাড় ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (হিল ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান) প্রস্তুতের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে। সদস্য হিসেবে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুজন অধ্যাপক। আছেন সড়ক ও জনপদ বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিডিএর প্রতিনিধি।

সিডিএ সূত্র জানায়, একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোর ঝুঁকি নিরসনের বিষয়ে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করেছে। সেখানে কী কী করণীয়, তা-ও বলা হয়েছে। তা যাচাইয়ের (ভেটিং) জন্য গত বুধবার চুয়েটের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। চলতি মাসে যাচাইয়ের কাজ শেষ হবে।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, সড়কটি নির্মাণে ১৬টি পাহাড় কাটা হলেও সবগুলো ঝুঁকিপূর্ণ নয়। সর্বোচ্চ পাঁচটি পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ঝুঁকি কীভাবে নিরসন করা যায়, তার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

পাহাড়ের ক্ষতি এড়ানো যেত
জরিমানা মওকুফের জন্য সিডিএর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত শুনানি শেষে পরিবেশ অধিদপ্তরের আপিল কর্তৃপক্ষের দেওয়া আদেশপত্রে বলা হয়েছে, সিডিএ প্রি-কনস্ট্রাকশন অ্যাকশন সঠিকভাবে করলে পাহাড়ের ক্ষতি কমানো সম্ভব ছিল। ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেওয়া আদেশে বলা হয়েছে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা একান্ত আবশ্যক। কিন্তু সিডিএ সড়ক করার জন্য শুরুতেই সাত লাখ ঘনমিটার পাহাড় কেটেছে। পাহাড়গুলো এমনভাবে কাটা হয়েছে, এখন তা রক্ষা করা প্রয়োজন। রাস্তা বন্ধ হলে যেমন চট্টগ্রাম নগরে যানজট সৃষ্টি হতে পারে, তেমনি পাহাড় রক্ষা না করলে পরিবেশ বিপর্যয় হবে। সিডিএ যদি অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শুরুর আগে সঠিক পরিকল্পনা করলে (প্রি-কনস্ট্রাকশন অ্যাকশন) পাহাড়ের ক্ষতি কমানো সম্ভব ছিল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ও গবেষক মো. কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়গুলো সুরক্ষিত রেখেও সড়ক নির্মাণ করা যেতো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাই করে। কিন্তু সিডিএ এমনভাবে পাহাড়গুলো কেটেছে, তাতে বরং ঝুঁকি বেড়েছে। বারবার পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশ-প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।