অন্য রকম নাচের আসর ‘থাবল চোংবা’

মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অংশ ‘থাবল চোংবা’ নাচ। এতে অংশ নিয়েছেন মণিপুরি তরুণ-তরুণীরা। ২২ মার্চ রাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুরের কোনাগাঁওয়ে
ছবি: প্রথম আলো

রাত বেশ গভীর। খোলা মাঠের মধ্যে ঠান্ডা মৃদু হাওয়া বইছে। বৃষ্টি হওয়ায় চৈত্র মাসেও এমন শীতের ছোঁয়া। কিন্তু তা গায়ে মাখছেন না কেউই। ঠান্ডা ছাপিয়ে উৎসবের উষ্ণতাই ছড়িয়েছে আশপাশে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে দল বেঁধে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষ এসেছেন খোলা মাঠে। সেখানে রঙিন কাগজ ও সুতোয় সাজানো তাঁবুর নিচে নাচের আসর। মণিপুরিদের অন্য রকম এই নাচের আসরের নাম ‘থাবল চোংবা’।

‘থাবল চোংবা’ নিয়ে হকতিয়ার খোলা মণিপুরি ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষক ও কবি কাইয়েন পাইবম বৃন্দা বলেন, বসন্ত ঋতুর চাঁদনি রাতে তরুণ-তরুণীরা একে অপরের হাত ধরে এই নাচ করেন। মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অংশ এই নাচ। পূর্বপুরুষ থেকে এটি চলে আসছে। বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজনেও এই নাচ হয়। মণিপুরি বর্ষবরণ উৎসব ‘চৈরাউবা কুম্মৈ’ উদ্‌যাপনের দিনও থাবল চোংবার আয়োজন থাকে। যেকোনো অঞ্চলের যেকোনো মণিপুরি থাবল চোংবাতে অংশ নিতে পারেন।

প্রায় প্রতিবছরই মণিপুরি-অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুরের কোনাগাঁওয়ে মণিপুরি বর্ষবরণ উৎসব ‘চৈরাউবা কুম্মৈ’ হয়ে থাকে। এ উৎসব শেষ হয় থাবল চোংবা দিয়েই। মণিপুরি বর্ষগণনা রীতি অনুযায়ী, বছরের প্রথম মাস ‘শাজিবু’র প্রথম দিনে ‘চৈরাউবা কুম্মৈ’ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এবারও ২২ মার্চ ইন্দো-বাংলা মণিপুরি চৈরাউবা উৎসব উদ্‌যাপন কমিটি এ আয়োজন করে।

বসন্ত ঋতুর চাঁদনি রাতে তরুণ-তরুণীরা একে অপরের হাত ধরে এই নাচ করেন।
কাইয়েন পাইবম বৃন্দা, কবি ও শিক্ষক
উৎসবে মাতেন তরুণ–তরুণীরা। ২২ মার্চ রাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুরের কোনাগাঁওয়ে
ছবি: প্রথম আলো

মণিপুরিদের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী ‘মলিয়াকুম’ নামে পরিচিত একটি বর্ষগণনা পদ্ধতির বর্ষবরণ উৎসব হচ্ছে ‘চৈরাউবা কুম্মৈ’। মণিপুরের ‘কোইকোই’ নামের একজন রাজা সিংহাসনে আরোহণের সময় ‘মোরিয়া ফমবালচা’ নাম ধারণ করেন। তিনি তাঁর নামানুসারে সন বা অব্দের নাম ‘মলিয়াকুম’ রাখেন। মণিপুরি ভাষায় নববর্ষকে বলে ‘অনৌবা কুম’। বর্ষবরণকে ‘শাজিবু চৈরাউবা’ সংক্ষেপে চৈরাউবা। ‘চৈ’ হচ্ছে লাঠি, ‘রাউবা’ চিৎকার। প্রাচীনকাল থেকে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত এক ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে কাঠদণ্ডের মাথায় পতাকা লাগিয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে উচ্চ স্বরে নববর্ষের সূচনার কথা জনসাধারণকে জানাতেন।

চৈরাউবা বা নববর্ষ ঘিরে নানা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠান, আনন্দ উৎসব হয়ে থাকে। নববর্ষের আগের রাতে তরুণ-তরুণীরা না ঘুমিয়ে ‘কড়ি’ খেলে কাটান। মণিপুরি লোকবিশ্বাসে রাতটিকে ভাগ্যরজনী মনে করা হয়। এ রাতেই দেবতারা মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। তাই সবাই খেলাধুলায় হাসি-আনন্দে রাত পার করেন। পরের পাঁচ দিনও তাঁরা কোনো কঠিন কাজ না করে ‘কড়ি’ খেলে হাসি-আনন্দে কাটিয়ে থাকেন। যাতে সারা বছরই এ রকম আনন্দে কাটে। নববর্ষের দিন ১০৮ পদের তরকারি রান্না করে যেমন দেবতাকে ভোগ দেওয়া হয়। তেমনি পাড়া-প্রতিবেশীকেও রান্নার ভাগ দেওয়া হয়। সবকিছু ধোয়ামোছা করা হয়। গৃহদেবতা সানামাহিকে পূজা দেওয়া ছাড়াও অপদেবতা তাড়াতে দেবতা শারই খাংবাকে সন্তুষ্ট করতে দেওয়া হয় ফলমূলের ভোগ। করা হয় আনন্দ শোভাযাত্রা।

এ নাচের আসরের নাম ‘থাবল চোংবা’।
ছবি: প্রথম আলো

নারীদের অংশগ্রহণে আয়োজন করা হয় কড়ি খেলা ‘লিকোন শানবা’। বিভিন্ন গ্রামের মণিপুরি নারীরা গোল হয়ে বসেন। হইচই করে ‘কড়ি’ খেলেন। যে দল জয় পায়, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় পুরস্কার। পুরো একটা দিন ঐতিহ্যের পোশাকে রঙিন হয়ে থাকে উৎসব প্রাঙ্গণ। এই চৈরাউবা কুম্মৈয়ের অন্যতম একটি অংশ হচ্ছে মণিপুরি লোকনৃত্য ‘থাবল চোংবা’। রাতে এ অন্য রকম নৃত্যটি প্রাণ নিয়ে আসে উৎসবে। সেদিন রাত ৯টার পর খোলা মাঠের তাঁবুর নিচে শুরু হয় ‘থাবল চোংবা’। মণিপুরি ভাষায় গান ধরেন গায়েন। গানে সৃষ্টিরই গুণকীর্তন চলে। তরুণ-তরুণীরা গানের সুর, তাল ও ছন্দে একে অপরের হাত ধরে তৈরি করেন সমুদ্র ঢেউয়ের। অল্প কয়েকজন দিয়ে শুরু হলেও একটা সময় পুরো তাঁবুটি বৃত্তাবদ্ধ নাচ-তরঙ্গে উচ্ছল হয়ে ওঠে। ঘুরে ঘুরে জলের সঙ্গে যেন জলের কথা চলতে থাকে।

‘থাবল চোংবা’ মণিপুরিদের আদি নৃত্য ‘খাম্বা-থুইবি’র একটি অংশ ধরা হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে এই নৃত্য চলে আসছে। ‘থাবল চোংবা’ নিয়ে আছে প্রচলিত বিভিন্ন লোককথা। এর একটি হচ্ছে, দেবতা শিদাবার দুই সন্তান সানামহী ও পাখাংবা। সানামহী সৃষ্টিতে মগ্ন থাকে। আর পাখাংবা শিশুর মতো যেন ধ্বংসতেই মজা পায়। শিদাবা তখন ‘লাইরেবী তারেৎ’ অর্থাৎ সাতজন দেবীকে তৈরি করেন। পাখাংবা যেদিকে যায়, দেবীরা পাখাংবাকে ঘিরে ঘুরে ঘুরে খেলা করে। যাতে সে কিছু ধ্বংস করতে না পারে। এই খেলাটি পরে থাবল চোংবায় রূপ নেয়। থাবল চোংবার বিভিন্ন পর্বের গানে সৃষ্টির আনন্দ, রাগ-অনুরাগ, প্রাণকে আবাহন, প্রশান্তির বিবরণ থাকে। এসব পর্বের মধ্যে ‘লাইরেন মঠেক’ পর্বে তরুণ-তরুণীরা কেউ কারও বাহু বন্ধন ছাড়তে পারেন না। এতে ‘লাইরেন’ বা শেষ পর্বে ভালোবাসারই চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। এ উৎসব মণিপুরি সংস্কৃতির অন্য সব আনন্দ উৎসবেরই একটি অংশ। আগে মণিপুরি অধ্যুষিত প্রায় সব গ্রামেই থাবল চোংবা উৎসব হতো। এখন সেটা আগের চেয়ে অনেক কমে আসছে।

‘থাবল চোংবা’ মণিপুরিদের আদি নৃত্য ‘খাম্বা-থুইবি’র একটি অংশ ধরা হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে এই নৃত্য চলে আসছে। ‘থাবল চোংবা’ নিয়ে আছে প্রচলিত বিভিন্ন লোককথা।

ইন্দো-বাংলা মণিপুরি চৈরাউবা উৎসব উদ্‌যাপন কমিটির সদস্যসচিব কবি সনাতন হামোম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদমপুরে প্রায় ২০ বছর ধরে আমরা চৈরাউবা কুম্মৈ উদ্‌যাপন করছি। নিজেদের একটা বর্ষ আছে, এটা আমাদের কাছে অহংকার করার মতো একটা বিষয়। এই উৎসবটিকে লালন, সংরক্ষণ করতেই এই আয়োজন।’
রাত বাড়ে, শেষ হয় নাচের একেকটি পর্ব। থাবল চোংবার আনন্দ রেশ ছড়িয়ে পড়ে। যত বিষাদ আছে, ক্লান্তি- পঙ্কিলতা আছে। তা মুছে দিয়ে প্রশান্তি আর নির্মল ভালোবাসাকে আহ্বান করার এক উৎসবের রেশ নিয়ে ঘরে ফেরেন সবাই।