আজও আলো ছড়াচ্ছে দেশের প্রাচীন বালিকা বিদ্যালয়টি

৮ জন ছাত্রী নিয়ে ১৮৬৩ সালে প্রায় ১৫ শতাংশ জমির ওপর বিদ্যালয়টি গড়েছিলেন কৃষ্ণধন মজুমদার নামের এক ব্যক্তি।

১৫৯ বছর ধরে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্য ও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়টি। জনশ্রুতি আছে, এটি বাংলাদেশের প্রথম ও অবিভক্ত বাংলার তৃতীয় নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেড় শ বছর পেরিয়েও আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে স্বমহিমায়।

বিদ্যালয় সূত্র বলছে, কুমারখালী শহরে পৌরসভার পদ্মপুকুর এলাকায় বিদ্যালয়ের অবস্থান। মাত্র ৮ জন মেয়েকে নিয়ে ১৮৬৩ সালে প্রায় ১৫ শতাংশ জমির ওপর বিদ্যালয়টি গড়েছিলেন কৃষ্ণধন মজুমদার নামের এক ব্যক্তি। এই মহতী কাজে সহযোগিতা করেছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ সহোদর রামধন মজুমদার ও কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন বিদ্যালয়টির প্রথম শিক্ষক।

বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ ছাত্রী আছে। ৩২ জন শিক্ষকসহ কর্মচারী আছেন ১৪ জন। প্রায় ২ একর ১৬ শতাংশ জমির ওপর ৩৪ কক্ষবিশিষ্ট ৬টি দ্বিতল ভবন রয়েছে। বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ ও কারিগরি পদ্ধতিতে পাঠদান চলছে। প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হার ৯০-এর বেশি। অধিকাংশ সময়ই উপজেলায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ। জেলায় ফলাফলে পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক ও রচনা প্রতিযোগিতায়ও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখে চলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।

এই বিদ্যালয়ের ১৯৭১ সালের ব্যাচের ছাত্রী মমতাজ বেগম। তিনি বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সে সময় নারীশিক্ষার কথা ভাবাই যেত না। সব স্থানে ছিল স্ত্রী শিক্ষায় বাধা। এই বালিকা বিদ্যালয় না থাকলে সেকালে আমার পড়াশোনাই করা হতো না।’

বিদ্যালয়ে সংরক্ষিত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, নারীশিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙালিদের মধ্যে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন ১৮৫৪ সালে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। ১৮৫৫ সালে কুমারখালীতে নারীশিক্ষার কাজ শুরু করেন রামধন মজুমদার ও কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। ১৮৬৩ সালের দিকে কুমারখালী বালিকা বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

১৮৬৬ সালে বিদ্যালয়টিতে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৪। ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কৃষ্ণধন মজুমদার পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর অগ্রজ রামধন মজুমদার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নিজ অর্থ ব্যয় করে আরও একটি টিনের ঘর নির্মাণে অনুজের প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টির উন্নয়নে তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। 

১৮৮০ সালে ভারতীয় প্রেসিডেন্সি বিভাগের স্কুল পরিদর্শক বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে এসে ভবন, জায়গা ও লেখাপড়ার মান দেখে সন্তুষ্ট হন। তাঁরই সুপারিশে ১৮৮০ সালে অক্টোবর মাস থেকেই বিদ্যালয়টি মাসিক ১২ টাকা সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত হয়, যা ব্রিটিশ সাহায্য হিসেবে স্মরণীয় ঘটনা।

১৯২৮ সালে বিদ্যালয়টিতে ছাত্রীসংখ্যা বেড়ে হয় ৮০। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান প্রমথনাথ চক্রবর্তী বিদ্যালয়ের আঙিনা বৃদ্ধি করেন। ১৯২৯ সালে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি দালানঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ইটের গাঁথুনি ও টিনের ছাউনিযুক্ত ঘর নির্মাণের সিদ্ধান্তে কুষ্টিয়ার তৎকালীন মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট পি ডি মার্টিন এ কাজে এগিয়ে এলেন। গৃহনির্মাণের ব্যয় নির্ধারিত হলো আনুমানিক তিন হাজার টাকা। এক-তৃতীয়াংশ স্থানীয় জনগণ, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ দেয় সরকার।

বর্তমানে বিদ্যালয়ে সাধারণ শাখায় বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগে প্রায় ১ হাজার ৪০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। কৃষিবিজ্ঞান, গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও কম্পিউটার বিষয়ে পাঠদানের অনুমতি রয়েছে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কারিগরি শিক্ষার তিনটি ট্রেড চালু আছে। প্রতিবছর এসএসসি ফলাফল পাসের হার ৯০-এর বেশি। জেএসসি ফলাফলও একই রকম। উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। 

জেলার মধ্যে ফলাফলে পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ অবস্থান রয়েছে। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি, যেমন ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতাতেও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিদ্যালয়ের আধুনিক বিজ্ঞানাগার রয়েছে, রয়েছে শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ও ভাষা ল্যাব। ভোকেশনাল শাখায় তিনটি বিভাগের পৃথক তিনটি পরীক্ষাগার রয়েছে। 

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম বলেন, অবিভক্ত বাংলায় তৃতীয় ও বাংলাদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় এটি। বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক ছিলেন কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। প্রায় ১৫৯ বছর ধরে বিদ্যালয়টি নারীশিক্ষার ঐতিহ্য ছড়িয়ে আসছে। যশোর বোর্ড ও জেলার মধ্যে ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে। 

বাংলাদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি ২০১৭ সালে জাতীয়করণ হয়। বিদ্যালয় সূত্র বলছে, বিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রী সরকারের মন্ত্রণালয়ে উপসচিব, বুয়েটের শিক্ষকসহ সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে কর্মরত রয়েছেন। 

বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিতান কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, কালের সাক্ষী হয়ে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে বালিকা বিদ্যালয়টি। ইতিমধ্যে জাতীয়করণ হয়েছে। ঐতিহ্য ও সাফল্য টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।