নলকূপ-সেচযন্ত্র ছাড়াই ৩৫ বছর ধরে পাইপ দিয়ে উঠছে সুপেয় পানি
নলকূপ নেই, সেচযন্ত্র নেই। তবু পাহাড়ের ঢালুতে শুধু মাটি খননের পর পাইপ বসালেই অনবরত বের হচ্ছে সুপেয় পানি। পানি তোলার এই পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে বরিং পদ্ধতি। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী চারটি গ্রামজুড়ে প্রায় ৩৫ বছর ধরে চলছে এমনই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক দৃশ্য।
এলাকাটিতে ৪০-৫০টি জায়গায় শুধু ৬০-৭০ ফুট মাটি খননের পর পাইপ বসালেই সারা বছর ধরে পানি উঠছে। কখনো থেমে যাচ্ছে না পানির ধারা। কোনো নলকূপ চাপতে হচ্ছে না, নেই কোনো বৈদ্যুতিক মোটরের ব্যবহার।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসী সূত্রে জানা যায়, শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী রানীশিমুল ইউনিয়নের পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত খড়ামুড়া, বালিঝুড়ি, রাঙ্গাজান ও ঝুলগাঁও গ্রামে তিন শতাধিক পরিবার বসবাস করে। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এখানে গভীর নলকূপ স্থাপন বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ, মাটির নিচে রয়েছে শক্ত পাথরের স্তর, ফলে গভীর খনন সম্ভব হয় না।
এ অবস্থায় প্রায় ৩৫ বছর আগে বালিঝুড়ি গ্রামে এক কৃষক নলকূপ স্থাপনের উদ্দেশ্যে মাটি খনন (বরিং) করতে গিয়ে মাত্র ৬০ ফুট গভীরে নামার পর দেখতে পান, পাইপ বসাতেই নিজে থেকেই পানি উঠতে শুরু করে। বিষয়টি আশপাশের মানুষকে বিস্মিত করে। এরপর ওই কৃষকের দেখাদেখি আশপাশের চার গ্রামের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি ঢালে বসবাসকারী অনেকে ৬০-৭০ ফুট গভীরতায় মাটি খনন করে পাইপ বসিয়ে একইভাবে অনায়াসে সুপেয় পানি পেতে থাকেন।
বর্তমানে এই পদ্ধতিতে ৪০-৫০টি বাড়ি ও আবাদি জমির পাশে সহজেই পানি পাওয়া যাচ্ছে। সারা বছর পানি চলমান থাকায় এই পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষদের আর পানির জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয় না। অনেক কৃষক খেতের পাশেই ‘বরিং’ করে পাইপ বসিয়ে সেই পানি দিয়েই চাষাবাদ করছেন।
দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য সরকারিভাবে চার থেকে পাঁচটি স্থানে মাটি খনন করে পাইপ বসিয়ে চারপাশ পাকা করে পানি ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এই পানিতে আয়রনের উপস্থিতি না থাকায় গ্রামবাসী খাওয়া, গোসল, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে চাষাবাদ পর্যন্ত সব কাজে নির্বিঘ্নে পানি ব্যবহার করছেন।
সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, রানীশিমুল ইউনিয়নের সীমান্ত সড়ক থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তর দিকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে খড়ামুড়া, বালিঝুড়ি, রাঙ্গাজান ও ঝুলগাঁও গ্রামের একাংশে পৌঁছাতে হয়। এখান থেকে ভারতের সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ মিটার। এই চার গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে সুমেশ্বরী নদী। নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পাশে পাহাড়ি ঢালে অবস্থিত এসব গ্রামের অনেক বাড়িতেই নলকূপ ছাড়াই অনবরত পানি উঠতে দেখা যায়। পাহাড়ের ঢালে ১০-১২টি বাড়ি ঘুরে একই চিত্র পাওয়া গেছে, নলকূপ বা মেশিন ছাড়া স্রেফ বরিং করা পাইপ থেকেই সারা বছর সুপেয় পানি উঠছে।
বালিঝুড়ি গ্রামের গৃহিণী হ্যাপী আক্তার বলেন, নলকূপ বসানোর মতো বরিং করে পাইপ বসাতেই পানি উঠতে থাকে, মেশিনের দরকার হয় না। সারা বছর পানি পাওয়া যায়। শীতে একটু গরম, গরমে ঠান্ডা থাকে। এটি তাঁরা খাওয়া, গোসল ও ঘরের কাজে ব্যবহার করেন।
পাহাড়ি এলাকায় পানির সংকট থাকলেও রানীশিমুল ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে বরিং করে পাইপ বসালে সহজেই পানি পাওয়া যায় বলে জানালেন ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ। এতে প্রায় ৩০০ পরিবার দীর্ঘদিন ধরে সুবিধা পাচ্ছে বলে তিনি জানান।
বিষয়টি ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করেছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জামাল হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মাটির নিচে পানির স্তরে নিম্নচাপ তৈরি হলে সেখানে স্প্রিং লেয়ার হয়। এর ফলে বরিং করা পাইপ দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই পানি ওঠে। তবে সব এলাকায় এমন হয় না। কিন্তু সেখানে অনবরত পানি বের হওয়াটা ব্যতিক্রম বিষয়।