যশোরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষককে বাড়িতে ডেকে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ

মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

যশোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে বাড়িতে ডেকে নিয়ে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে-বাণিজ্যের সুযোগ করে না দেওয়ায় তাঁকে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী। গত বুধবার নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও আজ শুক্রবার বিষয়টি জানাজানি হয়।

নির্যাতনের শিকার ওই শিক্ষকের নাম মোহাম্মদ নূরুল আমিন। তিনি যশোর আদর্শ বহুমুখী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ঘটনার পর ভুক্তভোগী প্রথমে যশোরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এবং পরে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এ ঘটনার পর ভয়ে তিনি বাড়ি থেকে কোথাও বের হচ্ছেন না। বিদ্যালয়েও যাচ্ছেন না। তাঁকে নির্যাতন-সংক্রান্ত একটি ভিডিও বার্তা গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রধান শিক্ষক নূরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিচালনা কমিটির মেয়াদ শেষের দিকে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হতে চান। বিদ্যালয়ে সম্প্রতি তিনজনের নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি (ফরিদ) ওই নিয়োগ আটকে রাখার জন্য কয়েকবার বলেছেন। বর্তমান কমিটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করে ফেলে। পরে তিনি (ফরিদ) নিয়োগপ্রাপ্তদের বেতন আটকে রাখার জন্যও চাপ দিতে থাকেন। এর মধ্যে ৯ নভেম্বর বিদ্যালয়ে অভিভাবক সমাবেশ ডাকা হয়। সমাবেশে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রধান অতিথি করা হয়। কিন্তু সমাবেশের আগের দিন গত বুধবার তিনি ফোন করে তাঁকে (নূরুল) তাঁর বাড়িতে ডেকে নিয়ে যান। এরপর তাঁর ক্যাডারদের দিয়ে সকাল ১০টা ১১ মিনিট থেকে দুপুর ১২টা ২৬ মিনিট পর্যন্ত শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন।

নূরুল আমিন অভিযোগ করে বলেন, নির্যাতনের সময় তাঁর ঘাড়ে, মাথায় চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মারা হয়। অভিভাবক সমাবেশে তাঁকে (ফরিদ) প্রধান অতিথি করতে বলা হয়। তাতে রাজি না হওয়ায় এমন নির্যাতন চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ছাড়া পেয়ে প্রথমে শহরের বেসরকারি কুইন্স হাসপাতালে ও পরে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। নির্যাতনের কারণে আমি এখন চোখে কম দেখছি। অসুস্থতার কারণে অভিভাবক সমাবেশেও যোগ দিতে পারিনি।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে যুবলীগ নেতা মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ওই শিক্ষক মাঝেমধ্যে তাঁর কাছে এলেও ৮ তারিখে আসেননি বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি রাজনৈতিকভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার। আমি কাউকে নির্যাতন করিনি। সবই বানোয়াট। বিদ্যালয়ের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ। বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় স্থানীয়রা চান, আমি নতুন কমিটির সভাপতি হই। সম্প্রতি সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ আমাকে বিদ্যালয়ের সভাপতি হওয়ার জন্য ডিও লেটার দিয়েছেন। আমি প্রধান শিক্ষক নূরুল আমিনের কাছে তা দিয়েও এসেছি।’

কুইন্স হাসপাতালের নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুমন কবীরের ব্যবস্থাপত্রে লেখা আছে, ‘ফিজিক্যাল অ্যাসাল্ট’ (শারীরিক মারধর)। আর যশোর জেনারেল হাসপাতালের টিকিটে লেখা আছে, ‘পুলিশ কেস।’

এর আগে ৩১ অক্টোবর রাতে হেলমেট পরা কয়েকজন প্রধান শিক্ষক নূরুল আমিনকে উপশহর পার্কে তুলে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির নির্বাচন বন্ধ রাখতে তাঁকে হুমকিধমকি দেওয়া হয়। ওই ঘটনার পরদিন যশোর কোতোয়ালি থানায় তিনি একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, জিডির বিষয়টি তাঁর জানা নেই। নির্যাতনের বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি।

অভিযোগ না করার কারণ জানতে চাইলে শিক্ষক নূরুল আমিন বলেন, ‘ফরিদ চৌধুরী ক্ষমতাধর মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে আমি লাগতে যাইনি। নির্যাতনের বিষয়টিও কাউকে জানাতে চাইনি। কিন্তু কীভাবে যেন বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। আমি নিরীহ মানুষ। আমি আর আমার স্ত্রী থাকি। আমাদের কোনো সন্তান নেই। দুজনই চাকরি করি। আমার সঙ্গেই কেন এমন হচ্ছে?’

যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আহসান হাবিব বলেন, প্রধান শিক্ষক নূরুল আমিনকে উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্যাতন চালানোর বিষয়টি তিনি ওই শিক্ষকের মাধ্যমে শুনেছেন। বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শককে এ নিয়ে খোঁজখবর নিতে বলেছেন। তিনি বলেন, যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বিদ্যালয়ের সভাপতি বা অভিভাবকদের কেউ নন। তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষা বোর্ড কতটুকু ব্যবস্থা নিতে পারবে, বুঝতে পারছেন না। ন্যায়বিচারের জন্য ওই শিক্ষককে থানা বা আদালতে মামলা করতে হবে।

আইনের আশ্রয় নেবেন কি না জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক নূরুল আমিন বলেন, শিক্ষক সমিতি ও অন্য প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।