‘ক্যান আছস তুই, এত দিন হড়ে আছিলি…’

কক্সবাজার সরকারি কলেজের হীরকজয়ন্তী উৎসবে বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস। আজ শনিবার দুপুরে কলেজ প্রাঙ্গণেছবি: প্রথম আলো

মাত্র ১৩ জন ছাত্র নিয়ে ১৯৬২ সালে শুরু হয়েছিল দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কক্সবাজার সরকারি কলেজের যাত্রা। সেই যাত্রার ৬০ বছর পূর্তির হীরকজয়ন্তী উদ্‌যাপনে যোগ দিতে ছুটে এসেছেন প্রাক্তন-বর্তমান আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে কেউ ছুটে এসেছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে, কেউ রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহীর কর্মস্থল থেকে। অনেকে আবার ছুটে এসেছেন সৌদি আরব, আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, জার্মানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে।

আজ শনিবার সকাল আটটা থেকে আট একরের বিশাল মাঠে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। সবাই ব্যস্ত টি-শার্ট, খাবারের কুপনসহ বিভিন্ন উপহারসামগ্রী সংগ্রহে। সঙ্গে চলে মুঠোফোনে সেলফি, ছবি তোলার হিড়িক। কেউ কেউ মুঠোফোনে ধারণ করেন প্রিয়জনদের মুখচ্ছবি।

সকাল ১০টার দিকে ক্যাম্পাসের এক পাশে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর ছবি তুলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির আহমদ চৌধুরী (৭২)। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর ছেলে ও পুত্রবধূ। ১৯৭০ সালে তিনি এই কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী উম্মে খালেদা খানম (৬৭) এই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন ১৯৭৪ সালে। তাঁদের সন্তান মো. শাহরিয়ার বিন নাসির এইচএসসি পাস করেন ২০০২ সালে। আর পুত্রবধূ ফারহানা আক্তার পাস করেন ২০০৬ সালে। এক পরিবারের চারজন সদস্য দল বেঁধে ক্যাম্পাসে হাঁটতে দেখে অনেকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির আহমদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কলেজ প্রতিষ্ঠার পর গত ৬০ বছরে এ ধরনের আয়োজন আর হয়নি। উৎসবে এসে নতুন-পুরোনো সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কুশল বিনিময় হচ্ছে, কে কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন—খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। দিনটা সবার মনে থাকবে।

শত শত শিক্ষার্থীর ভিড়ে শামীমা আক্তার ওরফে পারভীনকে চিনতে ভুল করেননি তাঁর একসময়ের সহপাঠী রেহেনা আকতার। শামীমা টেকনাফের হোয়াইক্যং স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। আর রেহেনা চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দা। দীর্ঘ ২৩ বছর পর ক্যাম্পাসে দেখা দুজনের। রেহেনাকে জড়িয়ে ধরে শামীমা আক্তার বলেন, ‘ক্যান আছস তুই, এত দিন হড়ে আছিলি।’

কক্সবাজার সরকারি কলেজের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার। আজ শনিবার দুপুরে কলেজ প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার শহরে প্রবেশের মুখে লিংক রোড এলাকায় ১৮ দশমিক ৯২ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজটি। ১৯৬৬ সালে কলেজে ডিগ্রি পর্যায়ে কলা ও বাণিজ্য এবং ১৯৭০ সালে বিজ্ঞান চালু হয়। ১৯৯৭ সালে চালু হয় বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও গণিত—এই ১৩টি বিষয়ে স্নাতক ও ছয়টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স। পাশাপাশি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা কোর্স চালু আছে। ১৯৮০ সালের ১ মার্চ জাতীয়করণ হওয়া এই কলেজটি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসির ফলাফলে সেরা ১০টি কলেজের একটি। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে পড়ছেন প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী।

দীর্ঘ ৬০ বছরে এই কলেজের শত শত শিক্ষার্থী সরকারি আমলা, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী হয়েছেন। হীরকজয়ন্তী উৎসবে কাছে পেয়ে বন্ধুদের অনেকে একে–অপরকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘কী খবর বল, এত দিন ক্যামন ছিলি, কোথায় ছিলি।’

বেলা ১১টার দিকে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্ত আলোচনা ও স্মৃতিচারণা। পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার। হীরকজয়ন্তীর এই আয়োজন ইতিহাস হয়ে থাকবে মন্তব্য করে শিরীণ আখতার বলেন, ‘আজ হলো গ্রহণের দিন, মতবিনিময়ের দিন।

হীরকজয়ন্তীতে আমরা সবাই মিলেমিশে আনন্দ-উল্লাসে দিনটিকে স্মৃতিময় করে রাখতে চাই।’ শিরীণ আখতার কক্সবাজারের মেয়ে। তাঁর বাবা আফসার কামাল চৌধুরী ছিলেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মুক্ত আলোচনায় স্মৃতিচারণা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরে জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান কামাল হোসেন চৌধুরী, কক্সবাজার সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফজলুল করিম, বর্তমান অধ্যক্ষ মো. গিয়াস উদ্দিন, প্রাক্তন ছাত্র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল করিম, সিনিয়র আইনজীবী নুরুল ইসলাম, আইনজীবী তাপস রক্ষিত, ছাত্রনেতা নুরুল আজিম কনক প্রমুখ।

হীরকজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে নাচে-গানে মঞ্চ মাতান স্থানীয় শিল্পীরা। আজ শনিবার দুপুরে কক্সবাজার সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

এই কলেজের প্রাঙ্গণে জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন উখিয়ার বাসিন্দা ফজলুল করিম। এর মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে শিক্ষকতা করেছেন ৩২ বছর। কলেজটির সাবেক অধ্যক্ষ ফজলুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৬৫ সালে তিনি ছাত্র হিসেবে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৭৩ সালে। এরপর ২০০৪ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ছিলেন অধ্যক্ষ। এরপর অবসর নেন তিনি।

উৎসব অনুষ্ঠানে নিজের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আর সেলফি তুলতে তুলতে হয়রান ফজলুল করিম বলেন, ‘অনেক দিন পর সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, অনেক আনন্দ লাগছে।’

বেলা একটার দিকে মুক্তমঞ্চে চলছিল রাখাইন সম্প্রদায়ের তরুণীদের নৃত্যগান। অন্যদিকে বিশাল প্যান্ডেলে একসঙ্গে দুই হাজার মানুষের মেজবানি খাবারের আয়োজন। সাদা ভাতের সঙ্গে গরু ও খাসির মাংস খেতে খেতে কানে বাজছিল জনপ্রিয় আঞ্চলিক গানটি, ‘কী সুন্দর দইজ্যার চর, সৈকত নগরী আঁরার হক্সবাজার…। কী সুন্দর লারদে অভাই, হত সুন্দর লার…।’