বইয়ের আলো ছড়ান যে প্রদীপ

প্রদীপ কুমার চৌধুরী

বাড়িতে ছিল পারিবারিক পাঠাগার। তাই ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। স্কুলজীবন থেকে বই সংগ্রহ শুরু। বই পড়া, নতুন বইয়ের সুঘ্রাণে আনন্দ পান। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছেন সবার মধ্যে। পরিচিতজন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বই বিলি করেন নিজের টাকায়। তাঁর ঘরটাই এখন যেন বই, পত্রপত্রিকা আর নানা প্রাচীন, মূল্যবান সামগ্রীর বড় সংগ্রহশালা।

৪০ বছর ধরে এভাবে বই সংগ্রহ ও বিনা পয়সায় বই বিলি করছেন সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বাসিন্দা প্রদীপ কুমার চৌধুরী (৭০)। ছিলেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের গ্রন্থাগারিক। অবসর জীবনেও তিনি শহরে বইয়ের দোকান ঘুরে ঘুরে বই কিনেন, পরিচিত বইপড়ুয়াদের মধ্যে বই বিলি করেন।

প্রদীপ কুমার চৌধুরীর জন্ম সুনামগঞ্জের ফতেপুর জমিদার পরিবারে। তাঁর বাবা মহেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। পরে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তিনি নিজের গ্রাম ফতেপুরে একটি পারিবারিক পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন সেই পাকিস্তান আমলে। নাম ছিল ‘ফতেপুর চৌধুরীবাড়ি পারিবারিক পাঠাগার’। কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাঠাগারটি ধ্বংস করে দেয়।

বাবা মহেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরীর মতো প্রদীপ কুমার একসময় বই সংগ্রহ শুরু করেন। তিনি সুনামগঞ্জ শহরে তাঁর বাড়িতেই ২০০৫ সালে গড়ে তোলেন আরেকটি পাঠাগার। তাঁর পাঠাগারে চার থেকে পাঁচ হাজার বই আছে। ঘরের আলমারি, টেবিল, সোফা, খাট—যেদিকেই চোখ যায়, সব জায়গায় রাখা বই আর পত্রপত্রিকা। এসব বইয়ের মধ্যে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, মনীষীদের জীবনী, রাজনীতি সংক্রান্ত বই উল্লেখযোগ্য। কয়েকটি আলমারিতে রয়েছে শখের বসে সংগ্রহ করা মূল্যবান সামগ্রী। এর মধ্যে পুরোনো পিতল-কাঁসার থালা-বাটি, ফুলদানি, কলমদানি, পশু–পাখির মূর্তি রয়েছে।

প্রদীপ কুমার চৌধুরী জানান, এ পর্যন্ত তিনি সহস্রাধিক ব্যক্তিকে বিনা মূল্যে বই উপহার দিয়েছেন। কেবল গত এক বছরে শহরের পরিচিত লেখক-গবেষক, কবি, আইনজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তি, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার ২০০ জনকে বিভিন্ন ধরনের বই উপহার দিয়েছেন।

প্রদীপ কুমার চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৭৯ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৮০ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে যোগ দেন গ্রন্থাগারিক হিসেবে। ২০১১ সালে তিনি আগাম অবসর নেন। তাঁর একমাত্র ছেলে শীর্ষদীপ চৌধুরী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। প্রদীপ চৌধুরীর স্ত্রী অপর্ণা সরকার বলেন, ‘এ বাড়িতে আসার পর থেকেই তাঁর স্বামীর বইয়ের নেশার বিষয়টি চোখে পড়ে। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হতাম। একসময় নিজেরও বিষয়টি ভালো লেগে যায়। ঘর ভরা বই, পত্রপত্রিকা। এসব নিজেই ঘুছিয়ে রাখার চেষ্টা করি।’

শহরের সৃজনশীল বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘মধ্যবিত্ত’র স্বত্বাধিকারী মানবেন্দ্র কর জানান, প্রদীপ চৌধুরী তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকেই গত এক বছরে অন্তত দেড় লাখ টাকার বই কিনে বিভিন্নজনকে উপহার দিয়েছেন। তাঁর পাঠাগারের জন্যও তিনি ঢাকা থেকে বেশ কিছু বই এনে দিয়েছেন।

প্রদীপ কুমার চৌধুরী একসময় নাটকের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। জেলা শিল্পকলা একাডেমির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। শহরের সারেগামা সাংস্কৃতিক তাঁকে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ সম্মাননা দিয়েছে। প্রদীপ কুমার চৌধুরী এখনো প্রতিদিন সাত-আটটি পত্রিকা কিনেন। সেখান থেকে রাজনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয়ের সংবাদ ও বিশ্লেষণধর্মী বিষয়টিগুলো কেটে সংগ্রহ করেন। প্রদীপ কুমার চৌধুরী বলেন, ‘বই পড়তে যেমন ভালো লাগে, তেমনি যাঁরা বইপড়ুয়া তাঁদের বই উপহার দিয়ে আনন্দ পাই। যতদিন বাঁচি বইয়ের সঙ্গেই থাকব।’