প্রক্সি সুবিধা নিয়ে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীর খাতা মূল্যায়ন হলো কীভাবে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় শিফটে ৯২ দশমিক ৭৫ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন তানভীর আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থী। তাঁর হয়ে (প্রক্সি) ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ধরা পড়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী বায়েজিদ খান। তিনি বর্তমানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দণ্ডিত হয়ে এক বছরের কারাভোগ করছেন।

এ নিয়ে জানাজানি হওয়ার পর গতকাল বুধবার তানভীর আহমেদের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

গত মঙ্গলবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ইউনিটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। প্রশ্ন উঠেছে, প্রক্সি দিতে এসে ধরা পড়ার পরও কেন ওই খাতা মূল্যায়ন হয়ে ফলাফল পর্যন্ত গড়াল। কেন ওই খাতা বাতিল করা হলো না। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এটাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৬ জুলাই এ ইউনিটের (সামাজিক বিজ্ঞান ও কলা অনুষদ) দ্বিতীয় শিফটের পরীক্ষায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু একাডেমিক ভবনের ৩০১ নম্বর কক্ষে প্রক্সি দেওয়া অবস্থায় ধরা পড়েন বায়েজিদ। টপ শিট অনুযায়ী, ওই কক্ষে মোট ৫০ জন পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। তবে পরীক্ষায় উপস্থিত হন ৪৮ জন। এর মধ্যে মূল পরীক্ষার্থী তানভীর আহমেদের হয়ে প্রক্সি দিচ্ছিলেন বায়েজিদ। ঘটনাটি ওই কক্ষের তিন পরীক্ষা পর্যবেক্ষক (এক্সাম ইনভিজিলেটর) বুঝতে পারেননি। একটি গোয়েন্দা সংস্থা পরীক্ষা চলাকালীন সেখানে এসে তাঁদের জানান, এখানে একজন অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে ওই গোয়েন্দা সংস্থা বায়েজিদকে আটক করে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় খাতাটি বাতিল করার পরামর্শ দিয়ে যান। পরীক্ষা হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা খাতা বাতিল না করে হাজিরা খাতা ও প্রবেশপত্রে নোট নিয়ে রাখেন। তবে খাতা বাতিল করেননি। এ কারণে ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিট পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হয়ে চলে যায় ডিন অফিসে। একইভাবে খাতাটিও মূল্যায়ন হয়ে ফলাফল পর্যন্ত গড়ায়।

ওই কক্ষে পরীক্ষা নিচ্ছিলেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহা. মনিরুল ইসলাম, ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক শাহানা কায়েস ও ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেফালী আক্তার। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক মোহা. মনিরুল ইসলাম বলেন, ওই দিন প্রক্সি দেওয়া শিক্ষার্থীকে তাঁরা শনাক্ত করতে পারেননি। পরীক্ষা চলাকালীন একটি গোয়েন্দা সংস্থা এসে তাঁদের জানায় যে একজন অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নোট নেন। ওই শিক্ষার্থী পুরো পরীক্ষা শেষ করার পর গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাঁকে আটক করে নিয়ে যায়। এ সময় তাঁকে খাতা বাতিল করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তিনি বিষয়টি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম খলিলুর রহমানকে জানান। পরে তিনি ওই শিক্ষার্থীর প্রবেশপত্রে লিখে দেন এই শিক্ষার্থী অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু টপ শিটে এটা উল্লেখ করেননি।

মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, তিনি টপ শিটে বা ওএমআর শিটে এটা করেননি এ কারণে যে এটা যেহেতু তাঁরা শনাক্ত করেননি। তিনি ভেবেছিলেন সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থা এটা আলাদা করে জানাবে ডিন অফিসে।

অধ্যাপক এম খলিলুর রহমান বলেন, এই ধরনের বিষয় তিনি শুনেছিলেন। সে অনুযায়ী একটা নোট দিয়ে দিতে বলেছিলেন ওই হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের। যেহেতু এটা তাঁরা ধরেননি। তাই হয়তো ওই শিক্ষক এটা বাতিল করেননি। তবে তিনি যদি প্রবেশপত্রে কিংবা হাজিরা খাতায় নোট দিয়ে দিতেন, তবে এটা মৌখিক পরীক্ষায় অবশ্যই ধরা পড়ত। কারণ, ফলাফল তৈরির সময় প্রবেশপত্র বা হাজিরা খাতার দরকার হয় না। ওই সময় টপ শিট আর ওএমআর শিট দেখা হয়। যেহেতু সংশ্লিষ্ট সংস্থা এটা ধরেছে, তাই ডিন অফিসকে তাঁদের অবহিত করা দরকার ছিল। এটা ডিন অফিসের দোষ নয়।

এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর এই প্রতিনিধির। তাঁরা বলছেন, ভর্তি পরীক্ষায় একজন পরীক্ষা পরিদর্শককে এক ঘণ্টায় পরীক্ষা নেওয়ার জন্য তিন হাজার টাকা দেওয়া হয়। হলের ভেতরে যে ঘটনাই ঘটুক না কেন, তা ডিন অফিসকে যথাযথভাবে জানানোই ওই কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজ।
একজন শিক্ষক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেছেন, একজন শিক্ষার্থী অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিলেন। তাঁর জেল হলো। তারপরও সেটি আবার ফলাফলে প্রথম হলো। এই কারণে এই পুরো পরীক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জায়গা রয়েছে। এর সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার।

ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, পরীক্ষা নেওয়ার কক্ষে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে এ বিষয়ে অবশ্যই একটি রিপোর্ট থাকতে হবে। যাতে ওই প্যাকেট খোলার পরই বোঝা যায় যে ওই সংশ্লিষ্ট খাতাটিতে সমস্যা রয়েছে। সেটা সবচেয়ে ভালো হয় টপ শিটে উল্লেখ করলে। একজন শিক্ষার্থীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে যাচ্ছে। এটা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণকক্ষে জানানোর দরকার ছিল। পরে নিয়ন্ত্রণকক্ষ এটা জানাবে এই ইউনিটের সমন্বয়কে। এ ধরনের কিছু না হয়ে থাকলে কক্ষে যাঁরা ছিলেন বা এর সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, এটা তাঁদের দায়। আর এ ঘটনা নিয়ে কিন্তু গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়েছে। রোল নম্বর সংগ্রহ করা দরকার ছিল সংশ্লিষ্ট ডিনের। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনেক সুন্দর হয়েছে। যে কয়েকজন ধরা পড়েছেন, এটা প্রশাসনের তৎপরতাতেই। তবে যে ঘটনাটি ঘটেছে, এটা সবার দায়। সবার দায় নিয়ে আরও সতর্ক হওয়া দরকার।

এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ইউনিটের সমন্বয়ক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইলিয়াছ হোসেনের সঙ্গে কথা হয় তাঁর দপ্তরে। তিনি ওই পরীক্ষার সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখিয়ে বলেন, এখানে টপ শিটে বা ওএমআর শিটে কোনো কিছু লেখা ছিল না। এ কারণে এটা ফলাফল পর্যন্ত চলে গেছে। এ নিয়ে একটা ভুল–বোঝাবুঝি হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেছেন, এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে সত্য উদ্‌ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।

২৬ জুলাই এ ইউনিটের দ্বিতীয় শিফটের পরীক্ষায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু একাডেমিক ভবনে প্রক্সি দেওয়া অবস্থায় ধরা পড়েন বায়েজিদ। একই দিন একই ইউনিটের দ্বিতীয় শিফটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে এসে দণ্ডপ্রাপ্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এখলাসুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল মেহজাবিন, চতুর্থ শিফটে প্রক্সি দিয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হন খুলনা মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সমীর রায়।

তাঁরা মূল পরীক্ষার্থী যথাক্রমে তানভীর আহমেদের হয়ে বায়েজিদ, লিমনের হয়ে এখলাসুর, ইশরাত জাহানের হয়ে জান্নাতুল মেহজাবিন, রাহাত আমিনের হয়ে পরীক্ষা দেন সমীর রায়। এরপর গত মঙ্গলবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, এ ইউনিটের ৩৯৫৩৪ রোল নম্বরধারী তানভীর আহমেদ প্রথম হন।

আরও পড়ুন