‘আমার দুইডা এতিম বাচ্চার জন্য কিছু কি করতে পারবাইন’

সাথী বেগমের সঙ্গে তাঁর দুই মেয়ে তামান্না ও মিতু
ছবি: সংগৃহীত

আজ মঙ্গলবার বেলা দেড়টায় অপরিচিত নম্বর থেকে এই প্রতিবেদকের কাছে ফোন এল। অপর প্রান্ত থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এক নারী বললেন, ‘আমি তাজুলের স্ত্রী সাথী। আমার দুইডা এতিম বাচ্চার জন্য কিছু কি করতে পারবাইন? আমরার তো সব শেষ হইয়া গেছে।’

গত রোববার গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমী ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে বাস-ট্রেন সংঘর্ষের ঘটনায় সাথীর স্বামী তাজুল ইসলাম (৩০) নিহত হন। তাজুল ইসলামের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোক ইউনিয়নের পাচুয়া গ্রামে। সাথী বেগম জানান, স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি এ প্রতিবেদকের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করেছেন। দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুতে তিনি দুই মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।

সাথী বেগম বলেন, ‘প্রত্যেক দিন আমার স্বামী যা ইনকাম করত, তা দিয়া আমাদের পরিবার চলত। রোববার থেকে আশপাশের মাইনষে আমাদের খাওয়াইতাছে। আমরা তো প্রতিদিন তার হাতের দিকে চাইয়া থাকতাম। এখন আমরা কী করাম!’

সাথী বেগমের বড় মেয়ে তামান্নার বয়স ৫ বছর, ছোট মেয়ে মিতুর বয়স ১০ মাস। মাত্র ১৪ দিন আগে তাজুল স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের একটি ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। দুর্ঘটনার আগের দিন শনিবার সাথী তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে কাপাসিয়ার সিংহশ্রী গ্রামে বাবার বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখান থেকে রোববার তিনি যান শ্বশুরবাড়িতে। সেদিন শ্বশুরবাড়ির পাশের একটি মাদ্রাসায় তামান্নাকে ভর্তি করানোর জন্য বেরিয়েছিলেন সাথী। ওই মুহূর্তেই দুর্ঘটনার খবর পান তিনি।

তাজুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

ফোনে সাথীর গলা জড়িয়ে আসছিল। সাথী বলেন, ‘একদিকে স্বামী হারাইছি, অন্যদিকে সন্তানগরে লইয়া চরম দুঃখের জীবনে জড়াইলাম। এখন আমরারে কে দেখব? একটা দুর্ঘটনায় সব শেষ হইয়া গেছে আমাদের।’

তাজুল ইসলামের বাবা হাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এক মেয়ে, দুই ছেলে। তাজুল ইসলাম তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। ঢাকা-কিশোরগঞ্জ সড়কে রাজদূত পরিবহনে কয়েক বছর কাজ করেছেন তাজুল। এরপর শ্রীপুরের মাওনা এলাকায় অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। পাশাপাশি স্থানীয় একটি কারখানার শ্রমিক পরিবহনের মিনিবাসের চালক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। যা আয় হতো, তা দিয়ে তাজুলের পরিবার চলত। তাজুল মারা যাওয়ার খবর প্রথমে তাঁর সন্তানদের জানতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু যখন বাড়িতে লাশ এল, তখন বড় মেয়ে চিৎকার করে কেঁদেছে। ১০ মাস বয়সী ছোট মেয়েটি কিছু না বুঝলেও মায়ের কান্না দেখে সে–ও অনেক কেঁদেছে।

গাজীপুর বিএম কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও পাচুয়া গ্ৰামের বাসিন্দা আসাদুজ্জামান আকাশ বলেন, বাড়ির ভিটা ছাড়া ওই পরিবারের আর কিছুই নেই। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন তাজুল। দুই সন্তানকে নিয়ে চলার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা তাঁর স্ত্রীর নেই। তাঁদের পাশে কাউকে না কাউকে দাঁড়াতে হবে।

তাজুলের বন্ধু ও অন্য একটি মিনিবাসের চালক মো. রুবেল গনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরীর মতো দুইটা মাইয়া। দেখলে মায়া লাগে। মাইয়া দুইটার কথা প্রায়ই বলত তাজুল। একটা দুর্ঘটনা মেয়ে দুইটাকে এতিম কইরা দিল। এই পরিবারকে এখন দেখার কেউ নেই।’