রাজশাহীতে এবার এত বেশি মানুষকে সাপে কাটছে কেন
সম্প্রতি রাজশাহীর চারঘাট বাজারে একজন কৃষক এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ভাই, আমাকে চিনতে পারেননি?’ আমি সময় নিচ্ছি দেখে তিনি নিজেই বললেন, ‘আমি সেই হেফজুল হক। আমার গালে কামড় দিয়েছিল রাসেলস ভাইপার।’
সাপে কামড় দেওয়ার পর হেফজুল হক সেই সাপ মেরে ব্যাগে করে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তিন দিনের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হন। পরে তিনি সপরিবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন, সে সময় তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের পরিচয় হয়েছিল।
রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় এখন সাপে কাটা রোগী বা তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা মেলে। কারণ, এ বছর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ৪৯০ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৫১ জন। এই সংখ্যা গত বছরের চেয়ে ১১৭ জন বেশি। গত বছরের চেয়ে এবার মৃত্যুর সংখ্যা ১১ জন বেশি।
রাসেলস ভাইপার বাড়ছে কেন
সাপ নিয়ে গবেষণা করেন রাজশাহীর বোরহান বিশ্বাস। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রশিক্ষক। সাপের উপদ্রবের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকতে গিয়ে রাসেলস ভাইপারের বেশি স্ত্রী প্রজাতির বাচ্চার জন্ম হচ্ছে। এবার বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে কেউটে সাপ বাইরের শীতল হাওয়া থেকে একটু উষ্ণতার জন্য মানুষের বিছানায় আশ্রয় নিতে গিয়ে মানুষকে কামড় দিচ্ছে।
ভেনম সেন্টারের গবেষণার কথা উল্লেখ করেন বোরহান বিশ্বাস। তিনি বলেন, সাধারণত রাসেলস ভাইপার নদীর তীরবর্তী ধানখেতে ও মাঠে বেশি দেখা যায়। এসব জায়গায় ছয় মাস চরম তাপমাত্রা থাকে আর ছয় মাস ভেজা স্যাঁতসেঁতে বা বন্যা থাকে। এই অতি চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ায় ভাইপার গোত্রীয় সাপ নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বেশি স্ত্রী প্রজাতির বাচ্চার জন্ম দেয়। সরীসৃপজাতীয় প্রাণীর মধ্যে স্ত্রী–পুরুষ প্রজাতির হার একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার ওপরে নির্ভর করে।
বোরহান বিশ্বাস ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাঁর ভেনম সেন্টারের গবেষণার জন্য একটি নির্দিষ্ট বয়সের রাসেলস ভাইপারের বাচ্চা সংগ্রহ করেছেন। সেখানে ৮৮টির মধ্যে ৮২টিই স্ত্রী প্রজাতির বাচ্চা পেয়েছেন। রাজশাহীর অন্য এলাকায় এদের জন্মহারে সমতা পাওয়া গেছে। আবহাওয়ার অতি চরম ভাবাপন্নতার কারণেই ২০১০ সাল থেকে রাজশাহীতে এই সাপ বাড়ছে।
প্রসঙ্গত, এবার রাজশাহীতে গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
সাপে কাটা ঠেকাতে করণীয়
কয়েক মাস আগে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাবনা সদর থানার আবদুল গাফফার (৫০) নামের একজন সাপে কাটা রোগী পাওয়া যায়। তিনি শসাখেতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তখন রাসেলস ভাইপার তাঁর হাতে কামড় দেয়। একই এলাকার বিল্লালকে (২২) রাতে ঘুমের মধ্যে সাপে কামড় দেয়। তিনি মশারি ছাড়া ঘুমিয়েছিলেন। মশারি ছাড়া ঘুমানো রাজশাহীর পবা উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের তাজউদ্দিনের (৫০) হাতে সাপে কামড় দিয়েছিল।
এ বছর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীদের জন্য বিশেষায়িত ওয়ার্ড চালু করা হয়। এর আগে চট্টগ্রামে স্নেক বাইট কর্নার চালু করা হয়েছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, গত ১৪ বছরের মধ্যে তিনি এত সাপে কাটা রোগী কখনো দেখেননি।
চিকিৎসকদের পরামর্শ, রাতের বেলায় অবশ্যই মশারি টানিয়ে চৌকিতে ঘুমাতে হবে। রাতের বেলায় বাইরে বের হলে টর্চলাইট জ্বেলে ও হাতে লাঠি নিয়ে শব্দ করতে করতে এগোতে হবে। মাঠে কাজ করার সময় গামবুট পরে কাজ করতে হবে। কোথাও কাজে হাত দেওয়ার সময় একটু দেখে নিতে হবে, আশপাশে কিছু আছে কি না।
বোরহান বিশ্বাস বলেন, সচেতনতার মাধ্যমেই সাপে কাটা এড়ানো সম্ভব। বিশেষ করে ধান কাটার সময় কৃষকেরা রাসেলস ভাইপারের দংশনের শিকার হন। যন্ত্র দিয়ে ধান কাটার কাজ করলে এটা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব। ধান কাটার সময় যদি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাহলে কৃষকেরা সাপের কামড়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আর যে সাপগুলো ধরা পড়ছে, সেগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করতে পারলেও কিছুটা রেহাই পাওয়া যেতে পারে।