দেশের অন্য এলাকার তুলনায় চট্টগ্রামে হৃদ্রোগী কেন বেশি
চট্টগ্রামে হৃদ্রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রাম বিভাগে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ৩৪ থেকে ৩৬ জন হৃদ্রোগী। অর্থাৎ এ বিভাগের প্রতি ৩০ জনের মধ্যে একজন হৃদ্রোগে আক্রান্ত। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত এক জরিপ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের আসমা বেগম। তবে সম্প্রতি পঞ্চাশোর্ধ আসমা বেগমের হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে চিকিৎসক পরীক্ষার পরামর্শ দেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক দেখলেন, আসমা বেগমের হৃৎস্পন্দন কমেছে, পাশাপাশি কমেছে কার্যক্ষমতাও। এরপরই তাঁর হৃদ্যন্ত্রের দুটি রক্তনালি সংকুচিত হয়ে গেছে। চিকিৎসক পরামর্শ দেন স্টেন্ট বা রিং পরাতে। বর্তমানে সেটির প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালের সামনে কথা হয় আসমা বেগম ও তাঁর ছেলে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। সাইফুল ইসলাম জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁর মায়ের হার্টে ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসক বলছেন মানসিক চাপ ও খাবার থেকে এটি হয়েছে। যেহেতু এটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা, তাই ডিসেম্বরের শেষে রিং পরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা।
আসমা বেগম একা নন, চট্টগ্রামে হৃদ্রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রাম বিভাগে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ৩৪ থেকে ৩৬ জন হৃদ্রোগী। অর্থাৎ এ বিভাগের প্রতি ৩০ জনের মধ্যে একজন হৃদ্রোগে আক্রান্ত। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত এক জরিপ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
‘হেলথ অ্যান্ড মরবিডিটি স্ট্যাটাস সার্ভে’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই জরিপে ২০২৪ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
বিবিএসের জরিপে জরিপ পূর্ববর্তী ৯০ দিনে প্রতি ১ হাজার জনসংখ্যায় রোগাক্রান্তের হার বসবাসের স্থান অনুযায়ী উপস্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে প্রতি ১ হাজার জনসংখ্যায় রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল প্রায় ৩৩২ জনের। এর মধ্যে হার্টের সমস্যা আছে, এমন রোগীর সংখ্যা প্রতি হাজারে ৩১ জনের বেশি। চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে এ হার প্রতি হাজারে ৩৪ থেকে ৩৬ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে সামগ্রিক রোগের প্রাদুর্ভাবের হার ১ হাজার জনে প্রায় ৩২৫ জন। জেলাভিত্তিক তথ্য জরিপ পাওয়া যায়নি।
‘হেলথ অ্যান্ড মরবিডিটি স্ট্যাটাস সার্ভে’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই জরিপে ২০২৪ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে ৮টি বিভাগের ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮৬ ব্যক্তির জরিপ পূর্ববর্তী ৯০ দিনের স্বাস্থ্যতথ্য নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বিভাগের ২৫ হাজার ৩৫১ জনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৮৯৬ জন পল্লী অঞ্চলের এবং ১২ হাজার ৪৫৫ জন শহরাঞ্চলের।
সাম্প্রতিক সময়ে হার্টের রোগী বেড়েছে। আধুনিক জীবনযাপন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়ামের অভাব, অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপ—সব মিলিয়েই চট্টগ্রামের মানুষের হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষ ও তরুণ বয়সীদের মধ্যে স্ট্রেস-সম্পর্কিত হার্টের সমস্যা বাড়ছে।
বিবিএসের চট্টগ্রাম বিভাগীয় যুগ্ম পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জরিপের আগের ৯০ দিনে রোগীদের কী ধরনের রোগব্যাধি হয়েছে, সেই তথ্য নেওয়া হয়। এ ছাড়া চিকিৎসার ধরন, বৈবাহিক অবস্থা, বয়স ইত্যাদি তথ্য নেওয়া হয়েছে। এ গড় থেকে জেলার একটি আনুমানিক তথ্য নেওয়া সম্ভব। যদিও সেটি নির্ভুল পরিসংখ্যান হবে না, তবে রোগের প্রাদুর্ভাব ও রোগীদের একটি ধারণা দেয়।
২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম জেলার জনসংখ্যা ৯১ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৫। এই হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রামের প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষের মধ্যে হৃদ্রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যদিও এ হিসাব আনুমানিক। তবে সম্প্রতি হৃদ্রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। হৃদ্রোগীর সংখ্যা জানতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি হিসাবে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে হার্টের তিনটি উল্লেখযোগ্য পরীক্ষা—ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি ও ইটিটি পরীক্ষা করিয়েছেন প্রায় ৬৫ হাজার রোগী। ২০২৪ সালে এসব পরীক্ষা করিয়েছেন প্রায় ৭২ হাজার রোগী। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চমেক হাসপাতালে এই তিনটি পরীক্ষা করিয়েছেন প্রায় ৫১ হাজার রোগী। এর বাইরে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালেও এসব পরীক্ষার রোগী বেড়েছে।
চিকিৎসকেরা জানান, চট্টগ্রামে হার্টের রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু ভৌগোলিক, পরিবেশগত, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের কারণ রয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে লবণাক্ততার মাত্রা বেশি—শুঁটকি, আচার, মাংস বেশি খাওয়া, অতিরিক্ত লবণ দিয়ে রান্না করা খাবার খাওয়ার প্রবণতা উচ্চ রক্তচাপ বাড়িয়ে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শহরের মানুষ বিশেষ করে ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা দীর্ঘ সময় কাজ, আর্থিক চাপ ও দুশ্চিন্তার কারণে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন, যা হৃদ্রোগের উল্লেখযোগ্য কারণ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদ্রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনিসুল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, আনুমানিক কত রোগী আছে, সেটি নির্ভুল বলা মুশকিল। তবে এটি সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে হার্টের রোগী বেড়েছে। আধুনিক জীবনযাপন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়ামের অভাব, অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপ—সব মিলিয়েই চট্টগ্রামের মানুষের হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষ ও তরুণ বয়সীদের মধ্যে স্ট্রেস-সম্পর্কিত হার্টের সমস্যা বাড়ছে।