‘আমরা আসলে গরিব, মধ্যবিত্ত লেবাস নিয়ে বিপদে থাকি’

শুক্রবার সকালে বাগেরহাট শহরে মাছের বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

দুটি কাগজি লেবু কিনবেন বলে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দোকানের সামনে বসে ছিলেন ষাটোর্ধ্ব মো. আতিয়ার শেখ। অনেক অনুরোধেও দোকানি কিছুতেই ১০ টাকার কমে একটি লেবু বিক্রিতে রাজি হলেন না। পরে ২০ টাকা দিয়েই ২টি লেবু নিলেন। ফেরার পথে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।

আতিয়ার বলেন, ‘বাজান, কী বলব। ডাব তো এখন বড় লোকের খাবার হইছে। চাইলেও কি আমাগো কেনার সুযোগ আছে। ইফতারে এট্টু লেবুপানি হলি পরাণটা জুড়োয়। কিন্তু এট্টা লেবু ১০ টাকা, কন, কী করে কী করি।’

বাগেরহাট বাসস্ট্যান্ডের কাছে ছোট একটি হোটেল আছে আতিয়ার শেখের। রোজায় বন্ধ রেখেছেন তাঁর সেই খাবার হোটেল। সকালে বাড়ির জন্য বাজার করতে বৈটপুর থেকে এসেছিলেন তিনি। কী বাজার করলেন, দাম কেমন, জানতে চাইলে হাতে থাকা থলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আতিয়ার বলেন, ‘বাজার তো এখন আর সাধারণ মানুষের নেই। সবকিছুর দাম বাড়তি। রোজার আগেরতেই তো সব দাম বাইড়ে আছে। এই ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে আমাগো চলা কঠিন।’

আজ শুক্রবার রোজার প্রথম দিনে বাজারে এসে এমন অভিব্যক্তি অনেকেরই। বিশেষ করে চাকরিজীবীদের। আজ বেলা সোয়া ১১টার দিকে বাজার করে হেঁটে বাড়িতে ফিরছিলেন প্রবীণ এক ব্যক্তি। কথা বলে জানা যায়। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চাকরি করতেন। অল্প কিছু ইফতারের বাজার নিতে এসেছিলেন। কাছে থাকা ছোট একটি কাপড়ের ব্যাগ দেখিয়ে বললেন, ‘একটা ডাব, চারটে লেবু আর তিনটে বেগুন কিনছি। এতেই ২২০ টাকা নিছে। একটা ডাবে নিল ১০০ টাকা! বলেন, আমরা কীভাবে চলি। পেনশনের কয় টাকা পাই, এ দিয়ে কী করে চলব? এখন হেঁটে যাচ্ছি।’ নাম ও ছবি প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আরও বলেন, ‘দেখেন, আমরা আসলে কিন্তু গরিব, মধ্যবিত্ত লেবাস নিয়ে বিপদে থাকি। না কিছু করতে পারি, না বলতে পারি। আমাকে ক্ষমা করবেন। যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়তেছে, এরপর কী হবে, চিন্তা করে পাই না।’

শুক্রবার সকালে বাগেরহাট শহরের কাঁচাবাজারের
ছবি: প্রথম আলো

বাজার ঘুরে দেখা গেল, সব পণ্যেরই পর্যাপ্ত জোগান থাকলেও দাম চড়া। সবজি, মাছ-মাংস—সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। আজ সকালে বাগেরহাট শহরের কাঁচাবাজারে প্রতি কেজি শসা ৫৫-৬০ টাকা, বেগুন ৮০ টাকা, পটল ৬৫-৭০ টাকা, টমেটো ৫০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১০০-১৪০ টাকা, গাজর ৫০ টাকা, ডাব ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। গত সপ্তাহেও এসব পণ্যের দাম ছিল কেজিতে ১০-৩০ টাকা কম।
ক্রেতারা বলছিলেন, এখন দাম জানতে চাইলে বিক্রেতারা বলছেন নতুন কৌশলে। মো. রিয়াজুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ‘আগে দাম জানতে চাইলে বলত কেজি হিসাবে, আর এখন বলে পোয়া (২৫০ গ্রাম) হিসাবে। আপনার প্রথমে শুনে মনে হবে দাম কম, কিন্তু কিনতে গেলে দেখবেন, কেজি পড়ছে কয়েক মাস আগের থেকে প্রায় দ্বিগুণ।’

তাঁর কথার সূত্র ধরে বাগেরহাট কাঁচা বাজারের বিভিন্ন দোকান ঘুরে বিক্রেতাদের কাছে সবজির দাম জানতে চাওয়া হয়েছিল। ছয়জন বিক্রেতার মধ্যে চারজন বলেন, ‘পোয়া ২০ টাকা।’ আর দুজন বিক্রেতা জানালেন, ‘পোয়া ২০ টাকা, কেজি নিলে ৭৫ টাকা।’ একইভাবে ঢ্যাঁড়স, পটলসহ বেশির ভাগ সবজির দাম বিক্রেতা বলছিলেন পোয়ার হিসাবে।

শুক্রবার সকালে বাগেরহাট শহরের ভৈরব নদ পাড়ের কাঁচাবাজারের পাশে
ছবি: ইনজামামুল হক

বাজার ঘুরে দেখা গেল, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কাগজি লেবুর দাম। ট্রলারচালক মো. শাহিন হাওলাদার বলছিলেন, দুই সপ্তাহ আগেও ১ ডজন (১২টি) লেবু কিনেছেন ৪০ টাকায়। আর আজ ১ হালি (৪টি) ৪০ টাকা। বেগুনের কেজি ৮০ টাকা। শসা ও টমেটো ৫০ টাকা কেজির নিচে নেই। তিনি বলেন, ‘দাম তো বাড়তিছে, ইনকাম তো বাড়াতি পারি না। রোজায় তো আমাগো যাত্রী আরও কুমে যায়। আয় কম, কিন্তু সবটার দাম বাড়তি। চারজনের পরিবার কী করে চালাব, বুঝে আসে না।’

কথায় কথায় শাহিন হাওলাদার বলছিলেন, ‘দ্যাহেন, মাছ-মাংসের বাজার তো এখন আর আমাগো নেই। ওইডা বড়লোকের বাজার হইছে। আপনি দাম দ্যাহেন না। কোনোটার দর করতে পারবেন না। ত্যালাপিয়া মাছের কেজিও হইছে ১৫০ টাকা। আর মাংস কেনা কি আমাগো সাজে কন?’