সময়ের মুখ

এই মাঠেই ছেলে আর্চারি খেলেছে, আমি চা বিক্রি করেছি

স্বামীর মৃত্যুর পর ১৫ বছর ধরে চায়ের দোকান চালিয়ে চার সন্তানকে বড় করেছেন, পড়াশোনা করিয়েছেন সেলিনা খাতুন। তাঁর ছোট ছেলে আর্চার সাগর ইসলাম আগামী ২৬ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠেয় অলিম্পিক গেমসে খেলবে। ছেলের এই সাফল্যের মধ্যে নিজের চায়ের দোকানটি উচ্ছেদের ঝুঁকিতে রয়েছেন সেলিনা। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

প্রথম আলো:

আপনার ছোট ছেলে সাগর ইসলাম অলিম্পিক গেমসে খেলার সুযোগ পাচ্ছেন। কেমন লাগছে?

সেলিনা খাতুন: খুবই ভালো। ছেলেকে নিয়ে আমি গর্বিত।

প্রথম আলো:

প্রতিবেশীরা কী বলছেন?

সেলিনা: তাঁরা বলছেন, সাগরের মা সোনার খনি পেয়েছেন।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

ঢাকায় ২৭ জুন আপনার ছেলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়েছে। গিয়েছিলেন?

সেলিনা: গিয়েছিলাম।

প্রথম আলো:

কী হলো সেখানে?

সেলিনা: সবাই আমাকে সাগরের আম্মা বলে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি ছেলের গলায় মেডেল পরিয়ে দিলাম। আমার ছবি তুলল, ভিডিও করল। খুব ভালো লাগল। কিন্তু যাঁরা চিরদিন আমাকে দুঃখী দেখেছেন, তাঁরা এই সুখ দেখে যেতে পারলেন না। আমার মা-বাবাও বেঁচে নেই। সাগরের বাবাও বেঁচে নেই। তাঁরা আজ থাকলে যে কী খুশি হতেন (বলতে বলতে চোখ মুছলেন)!

প্রথম আলো:

সাগরের বাবা কীভাবে মারা গিয়েছিলেন?

সেলিনা: অসুখে।

প্রথম আলো:

তারপর?

সেলিনা: চায়ের দোকান শুরু করলাম।

প্রথম আলো:

কীভাবে শুরু করলেন?

সেলিনা: অল্প কিছু জিনিস নিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু কলেজ মোড়ে (রাজশাহী নগরের মহানন্দা আবাসিক এলাকায়) চায়ের দোকান শুরু করেছিলাম। তখন এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

প্রথম আলো:

মানুষ সেই সময় এটা কি ভালোভাবে নিয়েছিল?

সেলিনা: মোটেও না। রাস্তার মোড়ে একটা মেয়ে মানুষ চায়ের দোকান চালাবে, এটা কেউ ভালো চোখে দেখেনি। তুলে দেওয়ার চেষ্টাও করেছে।

প্রথম আলো:

আপনি কী করেছিলেন?

সেলিনা: আমি হাল ছাড়িনি। বরং সন্তানদের নিয়ে ভোর ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকানে থাকতাম।

প্রথম আলো:

তারপর কী হয়েছিল?

সেলিনা: ওরা একসময় ক্ষান্ত দেয়।

প্রথম আলো:

দোকান ছাড়া আয়ের আর কোনো উৎস আছে?

সেলিনা: না। বিদ্যুৎ বিলসহ বাসাভাড়া ৫ হাজার টাকা। পাঁচজনের সংসার। চালানো খুব কঠিন।

প্রথম আলো:

আপনার চার সন্তান।

সেলিনা: দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে পড়াশোনা করে। বড় ছেলে ও এক মেয়ে স্নাতকে। ছোট ছেলে বিকেএসপিতে (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান)। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। বড়টা শ্বশুরবাড়িতে, ছোট মেয়েটা আমার সঙ্গে থাকে। বড় ছেলেটা বিয়ে করেছে।

প্রথম আলো:

আপনার দোকান তো রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) প্লটে।

সেলিনা: হ্যাঁ। একটি খালি প্লটের এক কোনায়।

প্রথম আলো:

দোকানটি উচ্ছেদ করতে কারা এসেছিল?

সেলিনা: আরডিএর লোকেরাই। যে লোক উচ্ছেদের কথা বলেছেন, তাঁকে একদিন আরডিএর গাড়িতে দেখেছি।

প্রথম আলো:

আপনাকে অন্য কোথাও পুনর্বাসন করা হলে কি যাবেন না?

সেলিনা: (কাঁদতে কাঁদতে) আমার সাগরকে আমি এই বাঁশের চরাটে শুইয়ে রেখেছি। এই মাঠেই (আরডিএর প্লট) ছেলে আর্চারি খেলেছে, আমি চা বিক্রি করেছি। আমি এই জায়গাটা ছাড়তে চাই না। এখানে সবাই চেনাজানা। ক্রেতাও আছেন। এখানে থাকতে পারলে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারব।

প্রথম আলো:

আরডিএর প্লটটিতে তো একসময় স্থাপনা হবে।

সেলিনা: এখন তো হচ্ছে না। প্লটটি খালি পড়ে থাকছে। সেখানে এক কোনায় আমার দোকানটি থাকলে কী এমন ক্ষতি!

প্রথম আলো:

আপনার ছেলের অলিম্পিকে যাওয়ার পেছনে আর কারও অবদান আছে বলে মনে করেন কি?

সেলিনা: এসবি আর্চারি ক্লাবের সভাপতি সাইফুদ্দিন আমার ছেলের জন্য অনেক করেছেন। বিকেএসপি আমার আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ছেলের বেতন সীমিত করে দিয়েছিল। আর্চারি ফেডারেশনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ছেলেকে সিটি গ্রুপ পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।