গাজীপুরের অরক্ষিত সড়কে ঝরছে প্রাণ

সূত্র: গাজীপুর মহানগর পুলিশ

গাজীপুর মহানগরের সড়কগুলোর বিভিন্ন জায়গায় চলছে খোঁড়াখুঁড়ি, যত্রতত্র চলছে তিন চাকার যানবাহন, ফুটপাত দখল। বাস–ট্রাকের বেপরোয়া গতিতে চলাচল তো আছেই। এসব কারণে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। ঝরছে মানুষের প্রাণ। অরক্ষিত সড়কগুলোতে নেই শৃঙ্খলা ফেরানোর জোরালো উদ্যোগ।

খোদ গাজীপুর মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে গাজীপুর মহানগর এলাকায় মোট সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৩৭৩টি। এতে মারা গেছেন ৩৩৫ জন। আহত হয়েছেন অন্তত ৫৪ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ২০২০ সালে। ওই বছর ৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭৮ জন। ২০২১ সালে ৭৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭৪ জন। এ ছাড়া গত বছর ৭৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৪ জন এবং ২০১৯ সালে ৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫ জন নিহত হয়। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৯ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬৪ জন।

গাজীপুর মহানগরে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর আরও অনেক বেশি বলে দাবি নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম আজাদ হোসেনের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সাধারণত কোনো দুর্ঘটনার বিষয়ে থানায় মামলা হলে বা কেউ অভিযোগ করলেই কেবল পুলিশ সেসব ঘটনা দুর্ঘটনা হিসেবে রেকর্ড করে। কিন্তু বাস্তবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে আরও অনেক বেশি। গাজীপুর মহানগর পুলিশ গত পাঁচ বছরে যে সংখ্যক সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর কথা বলছে, বাস্তবে তার পরিমাণ হবে দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি।

যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজরদারি না থাকায় মহানগরের সড়কগুলোতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। দেদার চলছে তিন চাকার যান। যেখানে–সেখানে থামানো হচ্ছে গাড়ি। এসব হচ্ছে পুলিশের সামনেই। এসব বন্ধে তেমন কোনো তৎপরতা নেই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষেরও (বিআরটিএ)।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে প্রতিদিন গাজীপুর থেকে রাজধানীর উত্তরায় যাতায়াত করেন মেহেদী হাসান। সড়কটির বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত্রতত্র ভাঙাচোরা, নেই সড়ক বিভাজক, নিয়ম–শৃঙ্খলা। এ কারণে সারাক্ষণই একধরনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হয়। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।’

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বেশি ঝুঁকি

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে সালনা পর্যন্ত প্রায় ১৭ কিলোমিটার সড়ক ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে আবদুল্লাহপুর থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশে রয়েছে বিআরটি প্রকল্পের খানাখন্দ। নেই সড়ক বিভাজক, পদচারী–সেতু। সুযোগ পেলেই মহাসড়কে উঠে যাচ্ছে তিন চাকার যানবাহন। মহাসড়কটির চান্দনা চৌরাস্তা থেকে সালনা অংশে ভাঙাচোরা নেই। তবে যত্রতত্র চলছে তিন চাকার যানবাহন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৩ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টায় টঙ্গীর কলেজ গেটে রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় মারা যান স্থানীয় বাসিন্দা ও সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সুহাদ মাহমুদ। ১৬ জুলাই ফাহিম নিহত হওয়ার বিচার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পাঁচ দফা দাবি তোলেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, সড়কটি অরক্ষিত। ওই শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার আগে ১ জুন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত শুধু কলেজ গেট এলাকায় পাঁচ থেকে ছয়জন সড়কে নিহত হন। এর বাইরে ২০২০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এই মহাসড়কের পোড়াবাড়ি এলাকায় বাসের বেপরোয়া গতির কারণে এক দিনেই চারটি পৃথক দুর্ঘটনায় মারা যান চারজন। ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর মিলগেটে বাসচাপায় মারা যান এক কলেজশিক্ষার্থী।

রিকশা-অটোরিকশার দৌরাত্ম্য

মহানগরের প্রতিটি সড়কেই ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশার দৌরাত্ম্য। ‘ইজিবাইক’ নামে পরিচিত এসব অটোরিকশাচালকদের কোনো লাইসেন্স নেই। বেপরোয়া চালানো, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো–নামানোয় প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। চলতি বছরের ১৩ আগস্ট নগরের ইউনুস সড়ক এলাকায় অসতর্কতাবশত অটোরিকশা ঘুরাতে গিয়ে মোটরসাইকেলের সঙ্গে সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন মোটরসাইকেলের চালক। দুমড়েমুচড়ে যায় মোটরসাইকেলটি। ২২ ফেব্রুয়ারি টঙ্গীর মধুমিতা এলাকায় অসতর্কভাবে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায় ইজিবাইকে থাকা এক শিশু। একইভাবে ২০২১ সালের মার্চে টঙ্গীর দত্তপাড়া এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় অটোরিকশার ধাক্কায় মারা যায় আট বছরের এক শিশু।

বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের যানই যখন কারণ

সড়কের বিশৃঙ্খলা নিরসণে ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর নগর এলাকায় চালু করা হয় চক্রকার বাস সার্ভিস। কথা ছিল মূল সড়কে কোনো ইজিবাইক চলবে না। কিন্তু এখন বাস, ইজিবাইক দুটিই চলছে। এতে যানজট বা বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। বেড়েছে দুর্ঘটনা। চক্রকার বাস সার্ভিসের দেওয়া বাসগুলো তাকওয়া পরিবহনের। শুরুতে ৫০টি বাস দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও এখন গাড়ি আছে ২৫০টির বেশি। এর মধ্যে অনেক গাড়ির কাগজপত্রের ঠিক নেই বলে জানান গাজীপুর বিআরটিএর একটি সূত্র। ফলে সড়কে চলছে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো, পাল্লা দিয়ে বাস চালানো, ভাড়া–নৈরাজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা।

যা বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা

মহানগর পুলিশের কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘দুর্ঘটনা কমাতে শুধু পুলিশ না, সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের দায়িত্ব রয়েছে। বিশেষ করে বিআরটিএ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তারা সেভাবে সমন্বয় করছে না।’

সড়কে বিশৃঙ্খলার বিষয়টি নজরে আনা হলে বিআরটিএর গাজীপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবু নাঈম বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সব সময়ই সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হয়।