জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ছাত্রদের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সরব ছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদুল হক। আবু সাঈদের মৃত্যুর পরের দিন অর্থাৎ গত বছরের ১৭ জুলাই ফেসবুকে তিনি লিখেছিলেন, ‘পুলিশ হত্যা করেছে সাঈদকে, সন্ত্রাসীদের থেকেও ঘৃণ্যভাবে। পুলিশ গুলি করল আমার শিক্ষার্থীকে তাঁর ক্যাম্পাসের মাটিতে দাঁড়িয়ে। একেবারে প্রবেশদ্বার ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে। পুলিশ এ সাহস কোথা থেকে পেল?’
মাহমুদুল হক আরও লিখেন, ‘আমি পরাহত, আমি অনুতপ্ত এ জন্য যে নিজ হাত দিয়ে ওই বন্দুকের নল চেপে ধরতে পারিনি। কারণ, আমি ঢাকা থেকে পথিমধ্যে ছিলাম। ক্ষমা করো আমাকে। আর কবরে শুয়ে দোয়া করো, আমরা তোমার শিক্ষকেরা যেন জোহা স্যারের ন্যায় মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারি।’
সেই শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানেরই একটি হত্যা মামলায়। গত আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে স্বামী হত্যার অভিযোগে ৩ জুন রংপুর নগরের হাজিরহাট থানায় মামলা করেন নগরের রাধাকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা আমিনা বেগম। সেই মামলায় গত বৃহস্পতিবার শিক্ষক মাহমুদুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা বলছেন, তিনি কেন কারাগারে থাকবেন! তাঁকে পরিকল্পিতভাবে টার্গেট করে ফাঁসানো হয়েছে।
মাহমুদুল হকের গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর বিষয়ে কথা বলতে শনিবার দুপুরে রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলীর কাছে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ, সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহানগর কমিটির সদস্যসচিব রহমত আলী, সাবেক সমন্বয়ক শামসুর রহমান, শাহরিয়ার সোহাগসহ ২০-২৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একটি দল। তবে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কী বিষয়ে কথা হয়েছে তা বলতে রাজি হননি পুলিশ কমিশনার।
একজন শিক্ষক জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ছাত্রদের পক্ষে ছিলেন। আবু সাঈদ হত্যার পর তিনি পুলিশি তদন্ত প্রত্যাখ্যান করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। সেই শিক্ষকের নামে মামলা হলো, গ্রেপ্তার করা হলো, তাঁর সম্বন্ধে পুলিশ জানবে না এটা হতে পারে না।
রহমত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি ভুয়া মামলায় মাহমুদুল হক স্যারকে তাঁরা গ্রেপ্তার করেছে। এই বিষয়টি হয়রানিমূলক। আমরা বলেছি, অতি দ্রুত তাঁর মুক্তির জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। পুলিশ কমিশনার বলেছেন, পুলিশের দিক থেকে যদি ভুল–বোঝাবুঝি হয়ে থাকে, অসহযোগিতা থাকবে না।’
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সোহাগ বলেন, তাঁরা মাহমুদুল হকের মুক্তির দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন। সেই সময় শেষ হয়েছে। রোববার মাহমুদুল হকের জামিন শুনানির কথা রয়েছে। শুনানির পর তাঁর জামিন না হলে তাঁরা পরবর্তী কর্মসূচি দেবেন।
বাদীও বললেন, তাঁর স্বামী স্ট্রোক করেছিলেন
মামলার বাদী আমিনা বেগমের স্বামী ছিলেন মুদিদোকানদার ছমেস উদ্দিন। মামলার এজাহারে আমিনা উল্লেখ করেন, রংপুরের স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গসংগঠনের উল্লিখিত নেতা–কর্মীরা গত বছরের ২ আগস্ট তাঁর স্বামী ছমেস উদ্দিনকে বাড়ি–সংলগ্ন মুদিদোকানের সামনে দেশি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর জখম করেন। পরে তাঁকে রংপুর প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে রাত আটটার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তবে ছমেস উদ্দিনের কবরে টাঙানো সাইনবোর্ডের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। সেখানে ছমেস উদ্দিনকে ‘জাতীয় বীর’ উল্লেখ করে লেখা আছে, ‘২ আগস্ট ২০২৪ পুলিশ বিভাগের একটি দল তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করলে তিনি পুলিশ দেখে দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে যান। তিনি সেখানে স্ট্রোক করে মারা যান—তা নিশ্চিত করেন প্রাইম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক।’
শনিবার দুপুরে রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামের ওই বাড়িতে গিয়ে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক কথা বলেন আমিনা বেগমের সঙ্গে। স্বামীর মৃত্যর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্ট্রোক করি মারা গেছে দৌড়িয়া পড়ি যায়া।’
আমিনা বেগম জানান, মামলার ক্ষেত্রে তিনি শুধু স্বাক্ষর করেছিলেন। কারা আসামি হবেন, এসব তিনি কিছুই জানেন না। রংপুর মহানগর জামায়াতে ইসলামীর লোকজন এসে মামলার জন্য সই নিয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
জামায়াতে ইসলামী রংপুর মহানগর কমিটির সেক্রেটারি আনোয়ারুল হক দাবি করেন, ছমেস উদ্দিন তাঁদের কর্মী ছিলেন। তাঁর দাবি, সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁরা কোনো মামলা করেননি। তবে স্থানীয় পর্যায়ে দলের লোকেরা সহযোগিতা করতে পারেন।
আমিনা বেগমের দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, মামলা যখন বাদী করেন, তখন জেনেশুনে ও দায়িত্ব নিয়ে করেন। আইনি ভাষায় মামলার প্রথম তথ্যদাতা হচ্ছেন বাদী। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। সুতরাং কেউ যদি বলেন, এটা সম্পর্কে আমি জানি না। আইনের পরিভাষায় এটা শুদ্ধ না।
মাহমুদুল হক জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ছাত্রদের পক্ষে ছিলেন, এটা জানেন কি না, জিজ্ঞেস করলে পুলিশ কমিশনার তাঁর (মাহমুদুল) ফেসবুক পোস্টগুলো তাঁকে পাঠাতে বলেন।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, একজন শিক্ষক জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ছাত্রদের পক্ষে ছিলেন। আবু সাঈদ হত্যার পর তিনি পুলিশি তদন্ত প্রত্যাখ্যান করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। সেই শিক্ষকের নামে মামলা হলো, গ্রেপ্তার করা হলো, তাঁর সম্বন্ধে পুলিশ জানবে না এটা হতে পারে না। পুলিশের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল।