মেহেরপুরে ভুল জায়গায় নর্দমা নির্মাণ

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাথুলী সড়কের হাটপাড়া বাজার নিচু এলাকা নয়। এখানে কখনো পানি জমে না। অথচ এখানে ড্রেন নির্মাণ করছে সড়ক বিভাগ। গত সোমবার তোলাছবি: প্রথম আলো

মেহেরপুরের কায়েমকাটা-কাথুলী আঞ্চলিক সড়কটি এক যুগ ধরে এলাকাবাসীর দুর্ভোগের নাম। মেহেরপুর পৌর শহর থেকে গাংনী উপজেলার কাথুলী পর্যন্ত আট কিলোমিটার এই সড়কের বেশির ভাগ স্থানে ইট-খোয়া উঠে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। প্রতি বর্ষায় এসব খানাখন্দ পানি-কাদায় একাকার হয়ে পড়ে। তখন যানবাহন চলা তো দূরের কথা, হেঁটে চলাই দায় হয়ে পড়ে। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৯ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়কটি সংস্কারে কাজ শুরু হয়েছে। বর্ষা আসার আগেই মে মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। তবে এ কাজ নিয়ে স্থানীয় লোকজন এখনই অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন।

প্রায় আড়াই মাস পেরিয়েও আট কিলোমিটার সড়কের কোথাও সংস্কারের কাজ শুরু হয়নি। প্রকল্পের মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনে ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনটি ড্রেন নির্মাণের কথা রয়েছে। এই আড়াই মাসে সেই ড্রেন নির্মাণের প্রাথমিক কাজ কেবল শুরু হয়েছে। কাজে ধীরগতির পর এই ড্রেন নির্মাণ নিয়ে স্থানীয় লোকজন আপত্তি তুলেছেন। তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, সড়কের যেসব স্থান নিচু, প্রতি বর্ষায় জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে, সেসব স্থানে ড্রেন নির্মাণ না করে সড়কের উঁচু স্থান ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে। ভুল স্থানে ড্রেন নির্মাণ করা হলে জলাবদ্ধতার কোনো সমাধান তো হবে না, উল্টো সরকারের টাকা তছরুপ করে উন্নয়নকে অকার্যকর করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া যেভাবে ঢিমেতালে কাজ হচ্ছে, বর্ষার আগে কোনোভাবেই কাজ শেষ হবে না। তখন প্রকল্পের মেয়াদ আবার বাড়িয়েও দুর্ভোগ শেষ হবে না।

যেখানে ড্রেন নির্মাণের জন্য এলাকাবাসী দীর্ঘ দিন থেকে দাবি জানাচ্ছিল, সেই জলাবদ্ধ স্থানে সড়ক বিভাগ ড্রেন নির্মাণ না করে একটি উঁচু স্থানে ড্রেনটি নির্মাণ করছেন। সরকারের লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে উন্নয়নকে ম্লান করে দিচ্ছেন এসব কর্মকর্তা। কয়েক দফা তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এরপরও তারা সেখানেই ড্রেনটি নির্মাণ করছে।
মিজানুর রহমান, ইউপি চেয়ারম্যান, কাথুলী

সওজ সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে ৯ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে কায়েমকাটা-কাথুলী আঞ্চলিক সড়কটির দরপত্র পেয়েছে ঢাকার আবেদ মুনসুর কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। তাদের হয়ে কাজ দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন কুষ্টিয়া এলাকার শহিদুল ইসলাম। প্রকল্পের অধীনে ড্রেনগুলো দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হবে।

গত সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, মেহেরপুর সদর উপজেলার কায়েমকাটা মোড়ে থেকে দুটি সড়ক দুই এলাকার দিকে গিয়েছে। বাঁ পাশের সড়কটি শোলমারী, শোভরাজপুর, তেরঘরিয়া গ্রামের দিকে গেছে। অন্যটি কাথুলী ইউনিয়নের সহগলপুর, হাটপাড়া, গাড়াবাড়িয়া, কাথুলী বাজারে গিয়ে ঠেকেছে। স্থানীয় লোকজন জানান, কায়েমকাটা থেকে কাথুলী পর্যন্ত সড়কটি দীর্ঘ ১২ বছর ধরে খানাখন্দে ভরে থাকে। সওজ বিভাগ বছরে একবার করে খানাখন্দগুলো ভরাট করে চলে যায়। কিন্তু নতুন করে কার্পেটিং করার অভাবে পুনরায় আবারও নতুন নতুন খানাখন্দ সৃষ্টি হয়ে যান চলাচলে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন ১৮ গ্রামের মানুষসহ যানবাহনের চালকেরা।

কাথুলী গ্রামের বাসিন্দা লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘এই সড়কের বেহাল দেখে অনেকে ইজিবাইক নিয়ে যেতে চান না। গাড়াবাড়িয়া গ্রামের মসজিদ এলাকায় এক হাঁটু পানি থাকে বর্ষার সময়। এরপর আবার বড় বড় খানাখন্দ। ইজিবাইকের চাকা গর্তে পড়লেই উল্টে পড়তে হয়ে। শুনেছি, হাটপাড়ায় ড্রেন নির্মাণ হচ্ছে। সেখানে তো আর পানি জমে না। যেখানে পানি জমে, সেখানে ড্রেন নির্মাণ করা প্রয়োজন। এই সড়কে কোনো কাজের ঠিক নেই। এমনিতে কয়েক স্থানে কার্পেটিং তুলে ফেলার কারণে চলাচল করতে কষ্ট হচ্ছে।’

সড়কটি ঘুরে দেখা যায়, সদর উপজেলার কুলবাড়িয়া, গাংনী উপজেলার সহগুলপুর ও হাটপাড়া বাজার এলাকায় তিনটি ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন জানান, কুলবাড়িয়া ঠিক আছে। সেখানে পানি জমে থাকে। কিন্তু সহগুলপুর ও হাটপাড়া বাজারে কখনো পানি জমে না। অপর দিকে সড়কের গাড়াবাড়িয়া ও পাকুড়তলা মোড়ে জলাবদ্ধতায় অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

কাথুলী ইউপির ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য জিনারুল ইসলাম বলেন, এই সড়কে বর্ষা মৌসুমে গাড়াবাড়িয়া দারুস সালাম মসজিদ এলাকার সামনে সবচেয়ে বেশি পানি জমে থাকে। ওই সময়ে সড়কে চলাচল করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় এলাকাবাসীকে। বড় কোনো যানবাহন চলাচল করতে উল্টে পড়ে সেখানে। ঠিকাদারি কোম্পানি যেখানে ড্রেন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে ড্রেন না করে উঁচু স্থানে ড্রেন করছে; যা সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবেদ মুনসুর কনস্ট্রাকশনের প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম বলেন, কাজ চলমান রয়েছে। এবারে সড়কের উপরিভাগ তুলে ফেলে নতুন করে কার্পেটিং করা হবে। সওজের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুয়ায়ী ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। কোন কোন স্থানে ড্রেন হবে, তা আগে থেকে সওজ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে রেখেছে। এখানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো গাফিলতি নেই।

গাড়াবাড়িয়া গ্রামের কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকানি আলী হোসেন বলেন, সড়কটির প্রতি অবহেলা রয়েছে সড়ক বিভাগের। ১২ বছরেও সড়কটিতে মানুষ আরামে চলাচল করতে পারেননি। সড়কের বেশির ভাগ স্থানে খানাখন্দ। এবার নতুন করে আরও একটি ঝামেলা তৈরি করেছে তারা। যেখানে ড্রেনের দরকার, সেখানে না করে উঁচু জায়গায় ড্রেন নির্মাণ করছে। আগামী বর্ষায় এই সড়ক দিয়ে মানুষ কেন, কোনো পরিবহনও চলাচল করতে পারবে না।

জানতে চাইলে সওজের মেহেরপুর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মুহাম্মদ মনজুরুল করিম বলেন, ড্রেন হওয়ার কথা বাজার এলাকায়। সওজ সব সময় তদারকি করে কাথুলী সড়কের তিন স্থানে ড্রেন নির্মাণের কাজ করছে। এর আগে সওজ কয়েক দফা এলাকায় ড্রেন নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন করেছে। এখানে কোনো গাফিলতি বা অনিয়ম হয়নি।

কাথুলী ইউপির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, যেখানে ড্রেন নির্মাণের জন্য এলাকাবাসী দাবি জানাচ্ছিলেন, সেই জলাবদ্ধ স্থানে সড়ক বিভাগ ড্রেন নির্মাণ না করে একটি উঁচু স্থানে ড্রেনটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সরকারের লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে উন্নয়নকে ম্লান করে দিচ্ছেন এসব কর্মকর্তা। কয়েক দফা তাঁদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এরপরও তাঁরা সেখানেই ড্রেনটি নির্মাণ করছেন।