পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন আসন
৭ বছর পর জাতীয় নির্বাচনে ফিরছে জেএসএস
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম বড় আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) জাতীয় নির্বাচনের রাজনীতিতে ফিরছে। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও আগামী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে দলটি। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি—তিন আসনেই প্রার্থী দেবে দলটি। তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থীর নাম ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে জেএসএস।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম বড় আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) জাতীয় নির্বাচনের রাজনীতিতে ফিরছে। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও আগামী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে দলটি।
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি—তিন আসনেই প্রার্থী দেবে দলটি। তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থীর নাম ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে জেএসএস। রাজনৈতিক দল হিসেবে জেএসএসের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না থাকায় স্বতন্ত্র হিসেবে লড়বেন দলের প্রার্থীরা। তবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে জেএসএসের ব্যানারে।
২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন জেএসএসের সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার। তিনি বলেন, নির্বাচন হলে জেএসএস অংশ নেবে। নির্বাচনে জয়লাভের ব্যাপারে তাঁরা আশাবাদী।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রথমে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন ঊষাতন তালুকদার। তবে দেশের ওই সময়ের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দলীয় সিদ্ধান্তে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছিলেন তিনি।
২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি আসনে আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) প্রার্থী দীপংকর তালুকদারকে হারিয়ে জিতেছিলেন জেএসএসের সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার।
জেএসএস সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল ২০১৮ সালে। ওই বছর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি আসনে দ্বিতীয় হয়েছিলেন জেএসএসের সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার।
জাতীয় নির্বাচনে জেএসএসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে বলে জানিয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো। কেননা, ৫০ বছরের বেশি পুরোনো পাহাড়ের এই রাজনৈতিক দলের স্থানীয় রাজনীতিতে বেশ প্রভাব রয়েছে।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাবনা কার্যত নেই। এতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে মূল লড়াই হওয়ার কথা থাকলেও পাহাড়ে তা হচ্ছে না। এখানে অন্যতম মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থাকবে জেএসএস। ইউপিডিএফও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রথমে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন ঊষাতন তালুকদার। তবে দেশের ওই সময়ের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দলীয় সিদ্ধান্তে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছিলেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা জানান, পাহাড়ের স্থানীয় ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে ভূমিকা রাখে আঞ্চলিক দলগুলো। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) না থাকায় এই দলগুলোর গুরুত্ব আরও বাড়বে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৭২ সালে। সক্রিয় রাজনৈতিক দল না হলেও ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতি কল্যাণ পরিষদের’ ব্যানারে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমা। যিনি জেএসএসের প্রতিষ্ঠাতা।
পার্বত্য চুক্তি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ২০০৭ সালে জেএসএস ভেঙে তৈরি হয় জেএসএস (এম এন লারমা)। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ ভেঙে তৈরি হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)।
জেএসএসের মতো নির্বাচনের মাঠে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে থাকার ঘোষণা দিয়েছে পাহাড়ের আরও তিনটি আঞ্চলিক দল। এগুলো হচ্ছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (এম এন লারমা)।
তাদের মধ্যে ইউপিডিএফ ও জেএসএস (এম এন লারমা) নির্বাচনে সরাসরি প্রার্থী দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নির্বাচনে প্রার্থী না দিলেও অন্য কোনো দলকে সমর্থন দেবে। আঞ্চলিক দলগুলোর নেতারা এমন তথ্য জানিয়েছেন।
ইতিমধ্যে দেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দুই দলের প্রার্থীরাও জেলা-উপজেলায় নির্বাচনী গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে এত দিন তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি।
অবশেষে তফসিল ঘোষণার আগমুহূর্তে নির্বাচনে লড়বে কি লড়বে না, সে বিষয়ে অবস্থান জানান দিয়েছে জেএসএস। অন্য দলগুলো তাদের অবস্থান দ্রুত জানাবে বলে জানা গেছে।
জেএসএসের সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদারের রাঙামাটিতে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বান্দরবানে জেএসএসের প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কে এস মং। তবে খাগড়াছড়ি আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা জানালেও কে লড়তে পারেন, তা এখনো জানা যায়নি।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তফসিল ঘোষণার আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ১০ বা ১১ ডিসেম্বর দুপুরে সাক্ষাতের সময় চাওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর তফসিল ঘোষণা করা হয়। ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে পরদিন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন আসনে সবচেয়ে বেশি জয় পেয়েছে বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক চারটি নির্বাচনে বান্দরবানে চারবার, রাঙামাটিতে তিনবার ও খাগড়াছড়িতে তিনবার জিতেছিলেন এই দলের প্রার্থীরা। তবে ২০০১ সালে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বিএনপির কাছে হেরে ছিল আওয়ামী লীগ। তখন আলোচনা ছিল, আঞ্চলিক দল জেএসএসের সমর্থন থাকায় বিএনপির জয়ের পথ সহজ হয়।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪–এ বিতর্কিত নির্বাচনে বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে জিতেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
আবারও জয়ের আশা জেএসএসের
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে জেএসএসের সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে রাঙামাটিতে। এখানে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
২০১৪ সালের নির্বাচনে রাঙামাটি আসনে জিতেছিল জেএসএসের প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জিততে না পারলেও ৯৪ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন তিনি।
দলের নেতারা জানান, ২০১৪ সালের নির্বাচনে রাঙামাটিতে জয়ের অভিজ্ঞতা এবারও কাজে লাগবেন তাঁরা। পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নের দাবি এবং পাহাড়ের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের বিষয়টি নির্বাচনী প্রচারণায় তুলে ধরবেন।
দলীয় সূত্র জানায়, জেএসএসের সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদারের রাঙামাটিতে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী করা হয়েছে বিচারকের চাকরি (জেলা যুগ্ম জজ) ছেড়ে রাজনীতিতে আসা দীপেন দেওয়ানকে। জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে আছেন আইনজীবী মোখতার আহম্মদ।
বান্দরবানে জেএসএসের প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কে এস মং। এখানে বিএনপির হয়ে লড়বেন বান্দরবান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাচিংপ্রু জেরী। এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন দলের বান্দরবান জেলার নায়েবে আমির আইনজীবী আবুল কালাম। তবে খাগড়াছড়ি আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা জানালেও কে লড়তে পারেন, তা এখনো জানা যায়নি।
জেএসএসের সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে জেএসএস অংশ নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করলে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে। এই তিন আসনেই তাঁরা জয়লাভের ব্যাপারে আশাবাদী।