তখন সবে মাধ্যমিকে পড়েন। পাড়ায় একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে নাটক পরিবেশিত হবে। এক বন্ধুর সঙ্গে সেই নাটকের মহড়া দেখতে গিয়ে তিনি নিজেও একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান। সেই থেকে শুরু। এখন ছোট পর্দা, ওটিটি আর বড় পর্দায় জনপ্রিয় অভিনেতাদের একজন তিনি।পাড়ার মঞ্চ থেকে রুপালি পর্দায় দ্যুতি ছড়ানো এই অভিনেতার নাম ইমতিয়াজ বর্ষণ। ভিন্নধর্মী চরিত্রে তাঁর সাবলীল অভিনয় মুগ্ধ করে দর্শকদের। চরিত্রের প্রয়োজনে বরাবরই নিজেকে ভেঙেছেন-গড়েছেন গুণী এই অভিনেতা। চট্টগ্রামের ছেলে ইমতিয়াজ বর্ষণের বড় পর্দায় অভিষেক হয় মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের ঊনপঞ্চাশ বাতাস ছবির মাধ্যমে। ২০২০ সালের অক্টোবরে থ্রিলার ঘরানার এই ছবি মুক্তি পায়। প্রথম ছবিতেই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর।ঊনপঞ্চাশ বাতাস-এর পর বড় পর্দায় আরও দুটি ছবি মুক্তি পেয়েছে বর্ষণের।
সিনেমা দুটি হলো চন্দ্রাবতীর কথা ও ওরা ৭ জন। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে ১৯৭১: করতলে ছিন্নমাথা, যাপিত জীবন, আগুনপাখি, এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরিসহ বেশ কটি সিনেমা। এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি নামে সিনেমাটির পরিচালক আহমেদ হাসান সানি। বর্ষণ অভিনীত এই ছবির পটভূমি গত বছরের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। তবে এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের ইতিহাসও তুলে ধরা হবে। বর্তমানে একটি সিনেমার শুটিং চলছে ইমতিয়াজ বর্ষণের।২০১৮ সালে আইফ্লিক্সের জন্য অমিতাভ রেজা নির্মিত বন্ধু অথবা বন্দুকের গল্প-এর মাধ্যমে ইমতিয়াজ বর্ষণ ওয়েবের জন্য প্রথম অভিনয় করেন। এরপর চরকির জন্য নির্মিত মুন্সিগিরি-তে অভিনয় করেছেন তিনি। পরে অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ কাইজার-এ।এরপর সাড়ে ১৬, গোলাম মামুন, কালপুরুষ, আকাসহ বেশ কিছু ওয়েব সিরিজে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়। এসব ওয়েব সিরিজে কখনো গোয়েন্দা, কখনো ব্যারিস্টারসহ নানা চরিত্রে দেখা গেছে তাঁকে। ইমতিয়াজ বর্ষণের অভিনীত ওয়েব ফিল্মের মধ্যে রয়েছে—ত্রিভুজ, অমীমাংসিত, নিশ্বাস, অপলাপ ইত্যাদি।টেলিভিশনের জন্য নির্মিত অনেক নাটকেও অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। করেছেন বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ ও অভিনয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ইয়েসু ওয়েব ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ২০২৪-এ অংশগ্রহণ করেন তিনি।প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শেখা না হলেও এরই মধ্যে গায়ক, সুরকার হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন বর্ষণ। তাঁর অভিনীত সিনেমা ঊনপঞ্চাশ বাতাস-এর ‘প্রথম ঝরে পড়া শিউলিটা’ গানটি তাঁরই সুর করা, যেটি বেসবাবা সুমন গেয়েছেন। আহমেদ রাজীবের কথা ও সুরে তাসনিম আনিকার সঙ্গে যৌথ কণ্ঠে গেয়েছেন ‘মিথ্যে বলিনি’। নিজের লেখা ও সুর করা গান ‘মেঘে মেঘে’ রিলিজ করেছে তাঁর গানের দল ‘হ্যালির ধূমকেতু’। এ ছাড়া অর্থহীন ব্যান্ডের মিউজিক ভিডিও আমার এ গান-এ অভিনয় করেছেন তিনি।বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্প অবলম্বনে ‘একটি খুনের বিবরণ’ শর্টফিল্মের নির্মাণ করেন মোর্শেদ হিমাদ্রি হিমু। সেখানেও অভিনয় করেন বর্ষণ। এই শর্টফিল্ম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৩, ঢাকা শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ২০২৪, নেপাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়।ইমতিয়াজ বর্ষণের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকার আমতলী গ্রামে।
তবে জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর ও হামজারবাগ এলাকাতে।অভিনয়ের শুরুর বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইমতিয়াজ বর্ষণ প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর বয়সে পাড়ায় একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান উপলক্ষে নাটকের মহড়ায় তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন রেজা নামে তাঁর এক বন্ধু। সেই অনুষ্ঠানের পরপরই ২৬ মার্চ উপলক্ষে আবারও একটি নাটকে অভিনয়ের জন্য ডাক পড়ে তাঁর। পরপর দুটি নাটকে অভিনয় করে নাটকের প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্মে। সেই ভালোবাসা ও আগ্রহ থেকেই যুক্ত হন চট্টগ্রামের তির্যক নাট্যগোষ্ঠীতে।নাট্যদলে কাজ করার পাশাপাশি নাটক বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের চেষ্টায় বর্ষণ ভর্তি হন ফেইম স্কুল অব ড্যান্স ড্রামা অ্যান্ড মিউজিকে ‘থিয়েটার অ্যাপ্রিসিয়েশন’ কোর্সে। তির্যক নাট্যগোষ্ঠীতে প্রায় সাড়ে তিন বছর কাজ করেছেন। এরপর তিনি যুক্ত হন থিয়েটার অ্যাভাঁগার্ড নামের একটি নাটকের দলে। একই সঙ্গে মূকাভিনয়েও সক্রিয় হন তিনি। যুক্ত হন ‘নাটুয়া নির্বাক সম্প্রদায়’ নামের দলে।অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণেও কাজ করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নায়ক নূর হোসেনকে নিয়ে ২০০৮ সালে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন মঈনুল আলম শাওন। বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় নামের ওই তথ্যচিত্র নির্মাণে যুক্ত ছিলেন বর্ষণ।
ভিন্নধর্মী চরিত্রে তাঁর সাবলীল অভিনয় মুগ্ধ করে দর্শকদের। চরিত্রের প্রয়োজনে বরাবরই নিজেকে ভেঙেছেন-গড়েছেন গুণী এই অভিনেতা।
পরে নাটুয়ার কর্ণধার দেবাংশু হোড়ের হাত ধরে ২০১০ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক নুরুল আলম আতিকের সহকারী হিসেবে ঢাকায় কাজ শুরু করেন। ছোটপর্দায় তাঁর প্রথম অভিনয়ও নুরুল আলম আতিকের নাটকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘শাস্তি’ অবলম্বনে সেটি নির্মিত হয়েছিল।ইমতিয়াজ বর্ষণের মাধ্যমিকের পড়ালেখা চট্টগ্রাম নগরের হামজারবাগ এলাকার রহমানিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে।
এরপর নগরের সরকারি কমার্স কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে চট্টগ্রাম কলেজে স্নাতকে ভর্তি হন তিনি। স্নাতকোত্তরও (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) সম্পন্ন করেছেন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে।মঞ্চ নাটকের প্রতি সব সময় টান অনুভব করেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। তবে নাটক, সিনেমা ও ওটিটিতে সময় দিয়ে এখন মঞ্চে সময় দেওয়াটা তাঁর জন্য কঠিন বলে জানালেন তিনি। গান শোনে, বই পড়ে ও সিনেমা দেখে অবসর কাটে তাঁর। গানের মধ্যে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের অনুরক্ত তিনি।
বেড়ানোর মতো সময় পেলেই ছুটে যান দেশের নানা প্রান্তে। পাহাড় খুব ভালো লাগে তাঁর। ভালোবাসেন আড্ডা দিতেও। ইমতিয়াজ বর্ষণ বলেন, ‘আমি পাহাড় ভীষণ ভালোবাসি। বেড়ানোর মতো সময় পেলে আমার প্রথমেই পরিকল্পনা থাকে দূর পাহাড়ে ঘুরে আসা।
এমনিতে অবসর পেলে নাটক-সিনেমা দেখি। সে ক্ষেত্রে নতুন যেসব নাটক-সিনেমা মুক্তি পায়, সেগুলোই বেশি দেখা হয়। নিজের অভিনয়ও নিজে দেখে সীমাবদ্ধতাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। দেশ-বিদেশের ধ্রুপদি নাটক-সিনেমাগুলোও বারবার দেখা হয়।’ নাটকের দলে যাঁদের কাছে শিখেছেন, যাঁদের সহায়তায় এত দূর এসেছেন, তাঁদের কথা বারবার স্মরণ করেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এর মধ্যে রয়েছেন তাঁর নাট্যগুরু অসীম দাশ, মূকাভিনয় শিক্ষক দেবাংশু হোড়; মঈনুল আলম শাওন, নাসির উদ্দীন খান, রফিউল কাদের রুবেল, নুরুল আলম আতিক, মাতিয়া বানু শুকুসহ তির্যক নাট্যগোষ্ঠী এবং থিয়েটার অ্যাভাঁগার্ড নাটকের দলের সদস্যরা।
রুপালি পর্দায় বলিষ্ঠ অভিনয়ের মাধ্যমে মানুষের জীবনের শিল্পিত রূপকে ফুটিয়ে তুলতে নিজের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে চান তিনি। ইমতিয়াজ বর্ষণ বলেন, ‘অভিনয়কে নিয়েই এখন আমার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান। আমি অভিনয় করে যেতে চাই। বাংলাদেশের নাটক-সিনেমা বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পাবে সেটিই প্রত্যাশায় থাকে সব সময়।’