‘যাদের ট্যাহা আছে, তাদের আছেই; আর যাদের নাই, তাদের কিছুই নাই’
মধ্যবয়সী লাল চান। ভোরবেলায় কাজের সন্ধানে খালি পেটে বের হয়েছেন। সকালে ছোট দুই সন্তান ও স্ত্রীর খাওয়ার মতো ঘরে কিছুই নেই। রেললাইনের বড় একটি পাথরের ওপর বসে বিষণ্ন মনে সড়কের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁকে কেউ না কেউ আজ হয়তো শ্রমিক হিসেবে কাজে নিতে আসবেন। দুই দিন ধরে তাঁকে কেউ কাজে নিচ্ছেন না। আজ কাজ না জুটলে ঘরে থাকা ছোট দুই সন্তান ও স্ত্রীকে উপোস থাকতে হবে। তাই চিন্তামগ্ন তাঁর মুখটি একদম মলিন।
লাল চান প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ২ দিন ধরে শ্রমিকদের হাটে কাজের জন্য ঘুরছেন। কিন্তু তাঁকে কেউ কাজে নিচ্ছেন না। শ্রমিকের কাজ করে জীবন চালান। আগের থেকে কাজ কমে যাওয়া এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এখন সংসার চালাতে গিয়ে পড়েছেন বিপাকে।
লাল চানের বাড়ি শেরপুর সদর উপজেলার নন্দীরবাজার এলাকায়। আজ রোববার সকাল আটটার দিকে জামালপুর শহরের গেটপাড় এলাকায় শ্রমিকের হাটে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গরিবের কষ্ট কেউ বোঝে না। বিল্ডিং বানানোর জোগালি খাটি। সবকিছুর দাম বাইড়ে গেছে। মানুষ বিল্ডিং এহন কম বানায়। তাই কাজ নাই। দিন আনি দিন খাই, ঘরে বাজার নাই। তিন বেলা বউ-সন্তানদের ঠিকমতো খাওন দিতে পারি না। ঠিকমতো একটু ডাইল-ভাতও জুগার করতে পারি না। কাজ না পেয়ে যখন বাড়িত বসে থাকি, তখন বউ কত কথা শুনায়। তখন শুধু চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। দেহেন, বাহি মুখে ঘর থাইকা বেরে হইছি স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাওন দেয়ার জন্য। এহন কেউ কাজে না নিলে আমি কী করব।’
লাল চান আরও বলেন, ‘সন্তানদের মুখের দিকে চাইতে পারি না। দু-এক দিন পরপর কাজ পাইলেও ৪০০ থেকে ৫০০ ট্যাহা ইনকাম হয়। সেই ট্যাহা নিয়ে বাজারে গেলে এক দিনেই শেষ। বাজারে জিনিসের দামে আগুন। গরিব মানুষ কমনে বাঁচবে? যাদের ট্যাহা আছে, তাদের আছেই; আর যাঁদের নাই, তাদের কিছুই নাই।’
লাল চানের মতো শ্রমিকের হাটে অর্ধশত শ্রমিক প্রতিদিন ভোর থেকে কাজের অপেক্ষায় বসে আছেন। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকেরা ভোরবেলা থেকে ওই হাটে কাজের জন্য আসেন। বিভিন্ন কাজের জন্য তাঁদের শ্রমিক হিসেবে নেন স্থানীয় লোকজন। সেখানে ২০ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের। তাঁরা সবাই দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নিজেদের হতাশার কথা জানান। তাঁরা বলেছেন, একদিকে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে, অন্যদিকে এলাকায় কাজকর্ম নেই। ফলে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। গত কয়েক মাসের ব্যবধানে ভোজ্যতেল, চাল, ডাল, মাছ, মাংস, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের সংসারে অভাব লেগে আছে। অনেকেই আবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে তাঁদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যে আছেন।
মেলান্দহ উপজেলার হাজরাবাড়ি এলাকা থেকে লেবু মিয়াও কাজের জন্য সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে শ্রমিকের হাটে বসে ছিলেন। কিন্তু সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত তাঁকে কেউ কাজে নেয়নি। তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, খুব কষ্টের মধ্যে আছি। গ্রামের মধ্যে কোনো কাজ নাই। তাই শহরে আসছি। এখানেও দুই দিন ধরে কেউ কাজে নিতে আসছে না। বেশির ভাগ শ্রমিক কাজ না পেয়ে ঘুরে যাচ্ছেন।’
৬৫ বছর বয়সী ফজলুর রহমানের বাড়ি শেরপুরের আমেরচর এলাকায়। কৃষিকাজ করে সংসার চালান তিনি। এলাকায় কৃষিকাজ নেই, তাই শ্রমিকের হাটে এসেছেন কাজের জন্য। সবার মতো তিনিও আজ কাজ পাননি। তিনি বলেন, ‘বৃদ্ধ বয়সে সাত সদস্যের সংসারের ঘানি টানতে হচ্ছে। একদিকে জিনিসপত্রের দামে আগুন, অন্যদিকে চার দিকে কামকাজ নাই। কিন্তু পেট তো সেই কথা মানে না। নিজে বাঁচতে হয়, অন্য সবার খাওনও জুগার করতে হয়। ৫০০ টাকা ইনকাম করে, এই বাজারে আর কী হয়? সেটাও প্রতিদিন মেলে না। সত্যি কথা বলতে, এখন আর ঘানি টানতে পারছি না। আল্লাহ এখন টান দিয়া নিয়া গেলেই বাঁচি।’