স্বেচ্ছাশ্রমে সড়ক নির্মাণ রূপ নিল দুই গ্রামের চড়ুইভাতিতে

একপাশে স্বেচ্ছাশ্রমে চলছে কাঁচা সড়ক নির্মাণের কাজ, অন্যপাশে দুপুরের খাবারের আয়োজন। বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার গুনাহার ইউনিয়নের দৃশ্য এটিছবি: প্রথম আলো

সবুজ খেতের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে মেঠোপথ। দুই গ্রামের বাসিন্দাদের স্বেচ্ছাশ্রমে পথটি কেবল তৈরি হয়েছে, কাজ এখনো শেষ হয়নি। কিছু দূর এগোনোর পর চোখে পড়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের মাঠে তখন চলছে দুপুরের রান্নার আয়োজন। কেউ চুলায় চাল চড়াচ্ছেন, কেউ কুটছেন মাছ, কেউ আদা-মসলা বাটছেন, কেউবা কাটছেন পেঁয়াজ-তরকারি।

বৃহস্পতিবার দুপুরে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার গুনাহার ইউনিয়নের কেউৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের দৃশ্য এটি। তিন শতাধিক মানুষের জন্য রান্নার আয়োজনে চাল, খেতের আলু, পুকুরের মাছ নিজেরাই দিয়েছেন। কেউবা দিয়েছেন নগদ টাকা।

কয়েক পুরুষ ধরে চলাচলের রাস্তা না থাকায় কেউৎ ও সুহলী গ্রামের বাসিন্দাদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছিল। গ্রাম দুটির মানুষ এবার একজোট হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে প্রায় দেড় কিলোমিটার কাঁচা সড়ক নির্মাণে নেমে পড়েছেন। কাজের পাশাপাশি দুপুরে খাওয়ার জন্য এই রান্নার আয়োজন, যা রূপ নিয়েছে দুই গ্রামের মানুষের চড়ুইভাতিতে।

কেউৎ গ্রামের এক পাশে যখন রান্নার আয়োজন চলছে, তখন গ্রাম দুটির একদল নারী-পুরুষ ডালি-কোদাল হাতে স্বেচ্ছাশ্রমে সড়ক নির্মাণের কাজ করছিলেন। কেউ কোদালের কোপে মাটি কাটছেন, কেউ ডালিতে মাটি ফেলছেন জমির আলে।

শুক্রবার সকালেও তৃতীয় দিনের মতো ডালি-কোদাল হাতে স্বেচ্ছাশ্রমে সড়ক নির্মাণের কাজে লেগে যান গ্রাম দুটির শতাধিক লোক। বিকেল পর্যন্ত তাঁরা পশ্চিমপাড়া থেকে সুহলী পর্যন্ত অংশের কাজ করেন। উদ্যোগের দলনেতা মতিউর মুন্না প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার পারিবারিক নানা কাজ থাকায় শুধু তরুণেরা কাজে এসেছেন। সড়ক নির্মাণের কাজ শনি-রোববারও পুরোদমে চলবে।

সুহলী থেকে কুড়াহার-অজুনগাড়ি পাকা সড়কের মোড় পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশ মাটি কেটে স্বেচ্ছাশ্রমে সড়ক নির্মাণকাজ শুরু হয় বুধবার। পাঁচ শতাধিক মানুষ এ কাজে যোগ দেন। কুড়াহার-অজুনগাড়ি পাকা সড়কের মোড় থেকে কেউৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত আধা কিলোমিটার মাটি কাটার কাজ শেষ করেন প্রথম দিন। গতকাল সকাল থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত দুই গ্রামের তিন শতাধিক মানুষ কেউৎ থেকে সুহলী পর্যন্ত আরও আধা কিলোমিটার অংশে মাটি কেটে সড়ক নির্মাণ করেন।

স্বেচ্ছাশ্রমে সড়ক নির্মাণের কাজ করছেন গুনাহার ইউনিয়নের দুটি গ্রামের মানুষজন
ছবি: প্রথম আলো

স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা নির্মাণের জন্য প্রথমে উদ্যোগ নেন সুহলী গ্রামের স্কুল-কলেজপড়ুয়া একদল তরুণ। উদ্যোগের দলনেতা জয়পুরহাটের রায়কালী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও সুহলী গ্রামের বাসিন্দা মতিউর মুন্না। তাঁর সঙ্গে আছেন সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসাইন, কলেজশিক্ষার্থী রাসেল, সাগর, ওবায়দুলসহ কয়েকজন। এ উদ্যোগে এগিয়ে আসেন কেউৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক চিত্ররঞ্জন, উৎপলসহ অন্যরা।

মতিউর মুন্না প্রথম আলোকে বলেন, দুই গ্রামে প্রায় এক হাজার মানুষের বাস। গ্রামবাসীর দুর্ভোগ লাঘবে এ উদ্যোগে যোগ দিয়েছেন এলাকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। মাছ ও আলুর ঘাঁটি দিয়ে দুই দিন দুপুরের ভাত খাওয়ানো হয়েছে।

গতকাল ও আজ দুপুরে নির্মাণাধীন সড়ক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুই গ্রামের কিশোর-তরুণ, নারী-পুরুষনির্বিশেষে কাঁচা সড়কটি নির্মাণের কাজ করছেন। সঙ্গে রয়েছেন গুনাহার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদও।

কেউৎ গ্রামের বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নিরেশ চন্দ্র বর্মন বলেন, ‘দুই গ্রামের মানুষের চলাচলের জন্য কোনো রাস্তা ছিল না। এতে বর্ষাকালে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বাসিন্দাদের। আমি নিজেও সাইকেল কাঁধে করে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতাম। কাদাপানির কারণে স্যান্ডেল বাড়িতে রেখে যেতে হতো।’

আট বছর আগের শ্রাবণ মাসের এক মধ্যরাতের ঘটনা মনে করে শিউরে উঠছিলেন সুহলী গ্রামের আবুল কাশেম। তিনি বলেন, ‘সেদিন গভীর রাতে মেয়ের প্রসব ব্যথা ওঠে। বর্ষাকাল বলে মাঠে একহাঁটু পানি। গ্রাম থেকে বেরোনোর পথ নাই। মেয়ের জীবন-মরণ সমস্যা। শেষে বাঁশের মাচায় করে মেয়েকে পাকা রাস্তায় নিয়ে ভ্যানে হাসপাতালে নিতে হয়। ওই কথা মনে হলে এখনো ভয় লাগে।’

বিজয়ের মাসে রাস্তা পেয়ে দুই গ্রামের মানুষের মধ্যে অন্য রকম বিজয়ের আনন্দ বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন গুনাহার ইউপি চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এ সড়কে ইট বিছানোর কাজও হবে।