কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের বাঁশি বাজার তখনো বাকি ১০ ঘণ্টা। কিন্তু দিনাজপুর শহরের বাঙ্গিবেচা ঘাটে প্রিয় দলের সমর্থকদের সময় যেন কাটছে না। আজ শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে বাঙ্গিবেচা ঘাট মোড়ে জড়ো হতে শুরু করেন ফুটবলপ্রেমীরা। একদিকে চলে বড় পর্দা টাঙানোর কাজ, অন্যদিকে খেলা উপলক্ষে চাঁদা তোলা হচ্ছে। খেলা শেষে থাকবে খিচুড়ির আয়োজন।
দিনাজপুর শহরের পশ্চিমের শেষ প্রান্তে পুনর্ভবা নদী। শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে নদীর পাড়ে বাঙ্গিবেচা ঘাট চৌরাস্তার মোড়। মুদিদোকান, চা–দোকান, ওষুধের দোকান—সব মিলিয়ে প্রায় ৪০টি দোকান আছে বাজারে। অন্য সময় সন্ধ্যার পর কমতে থাকে মানুষের আনাগোনা। তবে বিশ্বকাপ উপলক্ষে সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জমজমাট বাঙ্গিবেচা ঘাট।
আজ দুপুরে বাঙ্গিবেচা ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রিয় দলের জার্সি গায়ে, ফুটবল হাতে বিভিন্ন বয়সী ৩০ জনের মতো কিশোর–তরুণ মিছিল নিয়ে বাজারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরছে। হাত উঁচু করে প্রিয় দল ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার নামে স্লোগান দিচ্ছে। থেমে থেমে চিৎকার দিয়ে উঠছে ‘মেসি, মেসি’ আর ‘নেইমার, নেইমার’ বলে। চা–দোকানে চলছে চুল চেরা বিশ্লেষণ। খুদে শিশুরাও হরহর করে বলে যাচ্ছে প্রিয় খেলোয়াড়ের নাম।
আয়োজকদের একজন রুম্মন রাশেদ বাঁশের খুঁটি গেড়ে তাতে সাদা পর্দা লাগাচ্ছেন। ব্রাজিল দলের সমর্থক রাশেদকে পর্দা টাঙাতে সহযোগিতা করছেন ১০ জনের মতো তরুণ। রাশেদ জানান, এবার বিশ্বকাপের শুরু থেকে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দলের খেলার দিন প্রজেক্টর ভাড়া নিয়ে বড় পর্দা লাগিয়ে খেলা দেখার আয়োজন করে আসছেন তাঁরা। অন্যান্য দিন দেড় হাজার টাকায় প্রজেক্টর ভাড়া পেলেও আজ সাড়ে তিন হাজার টাকা গুনতে হয়েছে তাঁদের। জানালেন, আজকে দুটি বৃহৎ সমর্থক দলের খেলা থাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উন্মাদনা খানিকটা বেশি। রাতে খেলা শেষে খিচুড়ি খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার সমর্থক সবাই চাঁদা দিয়েছেন।
এই মোড়ে মুদিদোকান করেন তোফাজ্জল হোসেন (৩৭)। কোন দলের সমর্থক জিজ্ঞাসা করতেই হাত উঁচু করে বেশ চেঁচিয়ে বললেন, ‘ব্রাজিল’। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘আজ ব্রাজিল জিতবে। আমাদের নেইমার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আছেন কাসিমিরো, দানিলো, সান্দ্রো, ফ্রেডের মতো খেলোয়াড়। ফিফা র্যাঙ্কিং এ আমরা প্রথম। কেউ হারাতে পারবে না।’
পান চিবাতে চিবাতে তোফাজ্জলের কথার প্রতি–উত্তর করলেন সাজেদুর রহমান (২৮)। ঝাঁজালো কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, ‘বিশ্বসেরা খেলোয়াড় মেসি আছে, ভুলে গেলি হবি। আগের খেলাগিলাত দেখেন নাই, বল কেংকরি প্যাঁচ দিয়ে বাইর করি নিয়া গোল করোছে। ডি মারিয়া, মার্টিনেজের কথা তো এখনো বলিইনি।’
ওষুধের দোকানে বসে খেলার বিশ্লেষণ করছেন ফয়সাল হোসেন (২৪)। আর্জেন্টিনা দলের সমর্থক তিনি। আজকের খেলা নিয়ে আলোচনা নেই তাঁর। আছেন ফাইনাল খেলার আলোচনায়। তিনি বলেন, ‘যদি আজকে ব্রাজিল ভাগ্যক্রমে জিতে যায়, তাহলে সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে ফাইনাল খেলব।’ তাঁর মতে, ক্রোয়েশিয়ার তুলনায় নেদারল্যান্ডস অনেকটাই দুর্বল দল। তাই আজকের আর্জেন্টিনা দলের জয়ের বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই তাঁর।
এই মোড়ে বড় পর্দায় খেলা দেখতে আসেন পাশের মাঝাপাড়া, গোবরাপাড়া, মদিনা মসজিদ মোড় এলাকার ফুটবলপ্রেমীরা। চা–দোকানে বসা মাঝাপাড়া এলাকার বাসিন্দা রঘু রায় (৫০)। বলেন, ‘বাড়িতে টিভি আছে। কিন্তু এখানে চার শর বেশি মানুষ একসঙ্গে খেলা দেখার মজাই আলাদা। মনে হয় স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখা যাচ্ছে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়।’
মোড়ের দোকানে চা বিক্রি করেন আনোয়ার হোসেন। পুরি-জিলাপি-শিঙাড়াও বিক্রি করেন তিনি। আনোয়ার বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। খেলা দেখতে আসা মানুষের কারণে দোকানে বিক্রিবাট্টাও বেড়ে যায়। অন্যান্য দিনের চাইতে কম করে হলেও দুই হাজার টাকা বেশি বিক্রি হয়। তিনি বলেন, অনেকে শহর থেকে মোটরসাইকেলে করে এখানে আসেন খেলা দেখতে। দূরে গিয়ে খেলা দেখে আনন্দ পান। ভাজাপোড়া ও পিঠার দোকানও ভালো বেচাবিক্রি করে।