‘২১ দিন পরবাসী হলি অন্তত ছয় মাস নিশ্চিন্তে ভাত খাতি পারি’

গোপালগঞ্জে ধান কাটা শেষে মজুরি হিসেবে পাওয়া ধান নিয়ে নিজ এলাকা খুলনার কয়রা উপজেলায় ফিরেছে শ্রমিক দলটি। আজ শুক্রবার দুপুরে উপজেলার মহেশ্বরীপুর এলাকার সিবসা নদীর তীরেছবি: প্রথম আলো

চারদিকেই দুপুরের কাঠফাটা রোদ। ভরা গ্রীষ্মের এই তপ্ত রোদ মেখে ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে একে একে নামছেন কয়েকজন। তাঁদের মাথায় ধানের বস্তা আর চিবুক বেয়ে গড়ানোর অপেক্ষায় কয়েক ফোঁটা ঘাম। দুই হাতে বস্তা আঁকড়ে ধরায় ঘাম মোছার কোনো সুযোগই পাচ্ছেন না। তবু কারও চোখে–মুখে অস্বস্তির বিন্দুমাত্র রেশ নেই। ধান কাটা শেষে নিজেদের ভাগের ধান নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরছে ৪২ জন শ্রমিকের দলটি। আজ তাঁদের আনন্দের দিন।

আজ শুক্রবার দুপুরে দলটির সঙ্গে দেখা হয় খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর এলাকার শিবসা নদীর তীরে। শ্রমিকেরা জানান, জীবিকার সন্ধানে বোরো ধান কাটতে তাঁরা গোপালগঞ্জে গিয়েছিলেন। সেখানে কাজ শেষে নিজেদের মজুরি হিসেবে ভাগে পাওয়া ধান নিয়ে তাঁরা আবার এলাকায় পরিবারের কাছে ফিরেছেন।

ধানের বস্তাগুলো নৌকা থেকে নামিয়ে নদীর বেড়িবাঁধের ওপর স্তূপ করে রাখছিলেন শ্রমিকেরা। এ সুযোগে কোমরে বাঁধা গামছা দিয়ে ঘাম মুছে নিলেন আল-আমীন নামের এক শ্রমিক। তিনি বললেন, ‘২১ দিন আগে ধান কাটার শ্রমিক হিসেবে বাড়ি ছাইড়ে পরবাসী হইছিলাম। আজ সবাই ভাগের ধান নিয়ে ফিইরা আইছি। আমার নিজের ভাগে হইছে ১৮ মণ ধান। প্রতিবছর এই রকম ২১ দিন পরবাসী হলি অন্তত ছয় মাস নিশ্চিন্তে ভাত খাতি পারি।’

গতকাল বৃহস্পতিবার ও আজ কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এমন অনেক পরবাসী শ্রমিক দলকে ধান নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরতে দেখা গেছে। কোনো দল ফিরেছে বস্তাবোঝাই ট্রাক নিয়ে, আবার কেউ ফিরেছেন নদীপথে ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। তাঁদের প্রত্যেকের রোদে পোড়া চোখে-মুখে খেলছিল আনন্দের ঝিলিক।

কয়রা নদীতীরবর্তী তেলুতলা গ্রামের বেড়িবাঁধে কথা হয় আরেকটি শ্রমিক দলের সঙ্গে। দলটির সরদার কোবাদ মোড়ল বলেন, ‘আমাগের এলাকায় কাজকর্ম নাই, বাধ্য হয়ে তাই বাইরের এলাকায় যাই। গত পাঁচ বছর ধইরে বোরো ধান কাটার মৌসুমে দলবল নিয়ে যাই গোপালগঞ্জের কান্দিবাজার এলাকায়। থাকন-খাওনের ব্যবস্থা করে জমির মালিক। এবার দলে ১২ জন লোক ছিল। টানা ১৭ দিন মাঠে ধান কাইটে একেকজন ১৬ মণ ধান ভাগে পাইছি। সবাই মিলে ধান নিয়ে এলাকা পর্যন্ত আসতি ১৪ হাজার টাকা খরচ হইছে। এখন মনডায় বড্ড খুশি লাগতিছে।’

মাথায় ধানের বস্তা নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করছেন এক শ্রমিক। পরে এগুলো নিয়ে বাড়ি যাবেন তিনি
ছবি: প্রথম আলো

কয়রা উপজেলার লবণাক্ত এ জনপদে তেমন কোনো কাজ নেই। অধিকাংশ এলাকায় লোনাপানির চিংড়ির ঘের হওয়ায় ধান বা অন্য ফসল খুব একটা হয় না। মাছের ঘেরে খুব কম মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তাই বাধ্য হয়েই অনেকেই আয়রোজগারের জন্য এলাকা ছেড়ে দূরদূরান্তে কাজ করতে যান।

কয়রা থেকে প্রতিবছর কতসংখ্যক মানুষ ধান কাটা ও মাড়াইশ্রমিক হিসেবে এলাকা ছাড়েন, জানতে চাইলে কয়রা উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা গুরুদাস কুমার বলেন, ‘ধান কাটার মৌসুমে অন্তত তিন হাজারের মতো মানুষ বিভিন্ন জেলায় শ্রম দিতে যান। করোনাকালে ওই শ্রমিকদের একটি তালিকা করা হয়েছিল।’

উপজেলার বাসিন্দারা জানান, শুধু ধান কাটার শ্রমিক হিসেবেই নয়, প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে কিছু গ্রাম পুরুষশূন্য হতে শুরু করে। কোনো দল যায় সাগরে মাছ ধরতে, কেউ কেউ মহাজন বা সরদারের কাছে আগাম দাদনের টাকা নিয়ে যান শহরের কোনো ইটভাটায়।

এই জনপদে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর চিংড়ি চাষে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় বিপর্যয়ের চিহ্ন এখন বেশ স্পষ্ট। এ কারণে কাজের সুযোগ কম। তাই শ্রমজীবীরা অন্য এলাকায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অস্থায়ী অভিবাসী হয়ে বাড়িছাড়া এই জীবনও অনিশ্চয়তায় ভরা।
সাইফুল ইসলাম, সদস্যসচিব, উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলন

কয়রার মহারাজপুর এলাকার কামাল হোসেন জানান, গত বছর এলাকা থেকে ধান কাটতে গোপালগঞ্জে গিয়ে লাশ হয়ে ফেরেন দুই শ্রমিক। ভাগের ধান নিয়ে ট্রাকে বাড়ি ফেরার সময় কয়রা-খুলনা সড়কে ট্রাক উল্টে তাঁদের মৃত্যু হয়। এবার সেই ভয়ে তাঁরা কয়েকজন ধান কাটতে যাননি। সড়ক দুর্ঘটনার ভয়ে এবার অনেকেই নৌপথে নিজেদের এলাকায় ফিরেছেন।

৫৮ জনের একটি দল নিয়ে গতকাল হড্ডা গ্রামে ফিরেছেন সমরেশ কুমার মণ্ডল। তিনি জানান, ‘গত বছর ট্রাকে করে ধান নিয়ে ফিরেছিলেন, কিন্তু এবার সড়ক দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে এলাকায় ফিরেছেন নৌপথে। গোপালগঞ্জ জেলায় কাশিয়ানী এলাকায় গিয়ে টানা ১৬ দিন ধান কেটে একেকজন মজুরি হিসেবে ১৬ মণ করে ধান পেয়েছি। গরমে ধান কাটতে কষ্ট হলেও এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। ঘরে চাল থাকলে অন্য কাজ করে সংসারের বাদ বাকি কাজ করা সহজ হয়।’

উপকূলীয় জনপদে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির দাবি করে উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, এই জনপদে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর চিংড়ি চাষে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় বিপর্যয়ের চিহ্ন এখন বেশ স্পষ্ট। এ কারণে কাজের সুযোগ কম। তাই শ্রমজীবীরা অন্য এলাকায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অস্থায়ী অভিবাসী হয়ে বাড়িছাড়া এই জীবনও অনিশ্চয়তায় ভরা। উপকূলীয় জনপদে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হলে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনের সংকটও আরও বাড়বে।