‘এইবার কনে যাব, মরলি কবর দেয়ার জায়গাডাও নাই আমার’
খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ প্রান্তে দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন। এলাকাটির পর আর মানব বসতি নেই। শেষ প্রান্তে আড়পাঙ্গাসিয়া নদী, আর ওপারে সুন্দরবনের গহিন অরণ্য। প্রকৃতি আর মানুষের সহাবস্থানের এ প্রান্তরেখায় আংটিহারা গ্রামের অবস্থান।
পৌষের দুপুরে আড়পাঙ্গাসিয়া নদীতীর–সংলগ্ন বেড়িবাঁধ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নজর যায় একটি ভাঙাচোরা কুড়েঘরের দিকে। গত রোববার ঘরের সামনে একা বসে ছিলেন বৃদ্ধা। মুখে ক্লান্তি আর দীর্ঘ জীবনের ভার। বয়স জানতে চাইলে ফরিদা বেগম নামের ওই বৃদ্ধা একগাল হাসি ছড়িয়ে বলেন, ‘তা তো আর হিসাব কইরে রাখিনি, বাপু।’
কথায় কথায় জানা গেল, একসময় স্বামী-সংসার সবই ছিল ফরিদার। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল খুলনার চুকনগরে। স্বামী নজরুল মোল্লা ভ্যান চালাতেন, কখনো বাসের সহকারীর কাজ করতেন। সংসারে অভাব ছিল, তবে জীবন থেমে ছিল না। হঠাৎ একদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান স্বামী। থমকে যায় জীবন। বাপ-মা তো আগেই মারা গেছেন। কোথাও ঠাঁই না পেয়ে ফরিদা ফিরে যান নিজ জন্মস্থান আংটিহারায়।
দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফরিদা বেগম বলেন, ‘অনেক কষ্টে আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর চরে ছোট কুড়েঘর তুলি বসবাস শুরু করি। বেড়িবাঁধের পাশেই চরের মধ্যি আমার ঘর ছিল, জোয়ারে পানি আইত, ভাটায় নামত। ওইখানেই বিশ বছর কাটাইছি। এক বছর আগে হঠাৎ লোকজন আইসে কইলো, বেড়িবাঁধ উঁচু হবে। নদীর চর থেইকে মাটি নিতি হবে। আমার ঘর ভাইঙে ফেলতি হবে। আমি তখন আর কনে যাব? দুনিয়াতে আমার তো আর কেউ নেই। নিজের একটু জমিও নেই।’
এসব বলতে গিয়ে গলা ভারী হয়ে আসে এই বৃদ্ধার। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘এরপর বিলের মধ্যি একজনের মাছের ঘের পাহারা দেওয়ার ছোট একটা ঘরে গিয়ে উঠলাম। সেখানে তিন মাসের মতো ছিলাম। একদিন ঘেরের মালিক আইসে কইল, আর থাকা যাবে না। তখন আবার বের হুয়ি পড়লাম। শেষমেশ আশ্রয় মেলে বেড়িবাঁধের ভেতরের এই ঢালে। এখন শুনতেছি, সরকারি জাগার এইখানেও থাকা যাবে না। এইবার কনে যাব, তা-ই তো জানি না। মরলি কবর দেয়ার জায়গাডাও নাই আমার।’
জীবিকার জন্য ফরিদা বেগম নদীতে নেমে চিংড়ির পোনা ধরেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোনাপানিতে জাল টেনে যা পান, তা বিক্রি করেই কোনোমতে দিনাতিপাত করেন। কখনো বেড়িবাঁধে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য রান্নাবান্না করেন, কখনো গ্রামের যে যেদিকে ডাকেন, সেখানে গিয়ে কাজ করেন। তবে বয়সের ভারে এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না।
জীবিকার জন্য ফরিদা বেগম নদীতে নেমে চিংড়ির পোনা ধরেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোনাপানিতে জাল টেনে যা পান, তা বিক্রি করেই কোনোমতে দিনাতিপাত করেন। কখনো বেড়িবাঁধে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য রান্নাবান্না করেন, কখনো গ্রামের যে যেদিকে ডাকেন, সেখানে গিয়ে কাজ করেন। তবে বয়সের ভারে এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না।
আলাপের ফাঁকে ফরিদা বেগমের ঘরের ভেতরে ঢুঁ মারেন এই প্রতিবেদক। ভেতরে একটি মাটির চুলা, দু-একটি হাঁড়ি-পাতিল। একই ঘরে রান্না আর ঘুম। দিনের আলো ঘরে ঢুকছে ভাঙা চালের ফাঁকা অংশ দিয়ে। ফরিদা বেগম বললেন, ‘দিনে তাও আলো হয়। রাইতে কেরোসিনের কুপি জ্বালাই। বৃষ্টি হলি খুব কষ্ট হয়, চালের পানি সব ঘরে ঢোকে, শীতে বাতাস ঢোকে।’
ফরিদা বেগম জানালেন, তাঁর এক মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল খুলনার ফুলবাড়ীগেট এলাকায়। জামাতা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে দুই নাতনিকে বড় করেছেন ফরিদা। পরে মেয়েকে আরেক জায়গায় বিয়ে দেন। বড় নাতনিটি অল্প বয়সে মা হতে গিয়ে মারা গেছে। এখন ১৬ বছরের ছোট নাতনি খাদিজাও অন্তঃসত্ত্বা। সে সম্প্রতি বৃদ্ধার কাছে বেড়াতে এসেছে। খাদিজাকে দেখিয়ে ফরিদা বেগম বলেন, ‘এখন এই নাতনিটারে নিয়া ভয় লাগে। ওরও তো বয়স কম।’
সরকার বা কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পাশে দাঁড়ালে ফরিদা বেগম শেষ জীবনটা একটু ভালোভাবে কাটাতে পারবেন।আবদুস সালাম, বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান
বহু বছর ধরে ফরিদা বেগম নদীর চরে ঝুপড়িতে বসবাস করেছেন বলে জানান স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা। প্রতিবেশী নাসিমা খাতুন বলেন, ‘আমরাও গরিব মানুষ। মনডা চাইলেও সব সময় তাঁরে (ফরিদা বেগম) সহযোগিতা করতি পারিনে।’
ফরিদার অসহায় অবস্থা দেখে ভিজিডির একটি কার্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানান দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুস সালাম। তিনি বলেন, ‘এখন তাঁর (ফরিদা) মাথা গোঁজার জন্য একটি ঘর নির্মাণের চেষ্টা চলছে। সরকার বা কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পাশে দাঁড়ালে ফরিদা বেগম শেষ জীবনটা একটু ভালোভাবে কাটাতে পারবেন।’