সময় বাড়ে, প্রকল্প শেষ হয় না

জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য চলমান কাজের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বহদ্দারহাট এক কিলোমিটার এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে সেতু নির্মাণকাজ। এতে যানজটে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে চলাচলকারীদের। গতকাল বেলা ১১টায়ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম নগর পরিষ্কার রাখা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য সাতটি বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছিল ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। সাত বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে দুটি ভবনের নির্মাণকাজ শুরুই হয়নি। দফায় দফায় সময় বাড়িয়েও বাকি পাঁচটিরও কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কাজ বন্ধ করে চুক্তি বাতিলের আবেদন করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

শুধু পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আবাসন প্রকল্প নয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের চলমান আরও তিনটি প্রকল্পের কাজও চলছে ঢিমেতালে। ৩ থেকে ১১ বছর ধরে প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে। দফায় দফায় সময় বৃদ্ধি করেও প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ঠিক সময়ে প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পন্ন না হওয়ার কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মীদের পাশাপাশি নগরবাসীও।

জলাবদ্ধতা নিরসনে বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খননের সুপারিশ করা হয়েছিল ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনায়। প্রায় ২০ বছর পর ২০১৪ সালে তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। নির্ধারিত সময় ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজই শুরু করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। প্রকল্পটি তিন দফা সংশোধন করা হয়েছে। চার দফায় সময় বৃদ্ধি করা হয় আট বছর।

ভবন নির্মাণ ছাড়া অন্য তিনটি প্রকল্প হচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বহদ্দারহাটের বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্প; নগরের কুলগাঁও এলাকায় বাস টার্মিনাল নির্মাণ এবং নগরের বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়কের উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প। চার প্রকল্পের মোট খরচ হবে ৫ হাজার ৩৩৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৫০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

সিটি করপোরেশনের প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, অপ্রতুল বরাদ্দ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং বাধা-প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রকল্পগুলোর কাজ আটকে ছিল। সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন বলছেন, এখন কাজে গতি এসেছে, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনার ঘাটতিকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের কাজ বন্ধ। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম নগরের বান্ডেল রোড এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

দফায় দফায় সময় বেড়েছে

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য ২৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরে ৭টি ভবন নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই। এ প্রকল্পের আওতায় নগরের আন্দরকিল্লার বান্ডেল সড়কে তিনটি, জামালখানের ঝাউতলায় দুটি, ফিরিঙ্গিবাজার ও সাগরিকায় একটি করে মোট সাতটি ভবন নির্মাণ করার কথা ছিল। প্রতিটি ভবন ১৪ তলা। ফ্ল্যাট থাকবে ১ হাজার ৩০৯টি।

সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীরা জানান, ঝাউতলায় দুটি ভবন হওয়ার কথা থাকলেও হচ্ছে একটি। অন্য ভবনটি নির্মাণ করা হবে মাদারবাড়ীতে। ঝাউতলার ভবনটির ১২ তলার কাজ শেষ হয়েছে। মাদারবাড়ীর কাজ এখনো শুরু হয়নি।

বান্ডেল সড়কের তিনটি ভবনের মধ্যে একটির কাজ শুরু হয়নি। বাকি দুটির মধ্যে একটির ১১ তলা এবং অন্যটির ৫ তলার ছাদ ঢালাই হয়েছে। তবে এই তিনটি ভবনের কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হোসাইন কনস্ট্রাকশন-এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট বিডি গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কাজ বন্ধ রেখেছে। এখন চুক্তি বাতিলের আবেদন করেছে। ফিরিঙ্গিবাজারের ৪ তলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাই হয়েছে। সাগরিকার কাজ চলমান।

আগে প্রকল্পগুলোর কাজের অগ্রগতি ছিল কম। তবে এখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে। ইতিমধ্যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ভবনের দরপত্রপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। টার্মিনালের কাজও চলছে। নতুন খাল খননের কাজ শেষ পর্যায়ে।
শাহাদাত হোসেন, মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

এ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারজানা মুক্তা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন না হওয়া, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ঠিকাদারির প্রতিষ্ঠানের অনাগ্রহ এবং সময়মতো জায়গা বুঝে না পাওয়ার কারণে ভবনগুলোর নির্মাণকাজে দেরি হচ্ছে।

চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেট, মুরাদপুর, চান্দগাঁও, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খননের সুপারিশ করা হয়েছিল ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনায়। প্রায় ২০ বছর পর ২০১৪ সালে তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। নির্ধারিত সময় ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজই শুরু করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। প্রকল্পটি তিন দফা সংশোধন করা হয়েছে। চার দফায় সময় বৃদ্ধি করা হয় আট বছর। সর্বশেষ প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। ৩২৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এখন ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৩৪৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। বর্তমানে প্রকল্পের আওতায় নগরের বহদ্দারহাট এক কিলোমিটার এলাকায় সেতু নির্মাণ এবং সেতুর দুই পাশে সড়কের নির্মাণকাজ বাকি রয়েছে।

সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. ফরহাদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, জমি অধিগ্রহণ জটিলতাসহ নানা কারণে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। তবে এখন কোনো সমস্যা নেই।

চট্টগ্রাম নগরের প্রবেশমুখ অক্সিজেন এলাকায় কোনো টার্মিনাল ছিল না। সড়কের মোড়টিই টার্মিনালে রূপান্তর হয়। প্রতিদিন শত শত গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে ব্যস্ততম মোড়টিতে। এতে প্রায় সময় যানজট লেগে থাকে। নগরের প্রবেশমুখের এই জটিলতা নিরসনে কুলগাঁও এলাকায় বাস টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। তিন দফায় সাত বছর সময় বাড়িয়েও টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।

সিটি করপোরেশনের এক নথির তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের জন্য ৮ দশমিক ১০ একর জমি অধিগ্রহণে জটিলতা ছিল। পরে জমি পাওয়া গেলেও গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর প্রায় ছয় মাস কাজ বন্ধ ছিল। এ কারণে টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ হয়নি।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রকল্প হচ্ছে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’।

২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম ইয়াজদানীকে ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে মারধর করে একদল ঠিকাদার। ওই ঘটনার পর প্রকৌশলী মো. গোলাম ইয়াজদানী আর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে আসেননি। পরে নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে আরেক দফা প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করা হয়।

প্রকল্প পরিচালককে মারধর, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি ছিল কম। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৫৮ শতাংশ এবং ব্যয় হয় ১ হাজার ১৯৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় নগরে সড়ক সম্প্রসারণ, পদচারী-সেতু (ফুটওভার ব্রিজ), গোলচত্বরের উন্নয়ন, সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করার কথা রয়েছে।

চলমান প্রকল্পগুলোর কাজের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আগে প্রকল্পগুলোর কাজের অগ্রগতি ছিল কম। তবে এখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে। ইতিমধ্যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ভবনের দরপত্রপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। টার্মিনালের কাজও চলছে। নতুন খাল খননের কাজ শেষ পর্যায়ে। আর আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ বৃষ্টির জন্য আপাতত বন্ধ রয়েছে। বৃষ্টির মৌসুম শেষ হলে পুরোদমে কাজ শুরু হবে।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে, এটা তো হতে পারে না। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ না হওয়ায় মানুষ দুর্ভোগে আছেন। সিটি করপোরেশন প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় না নিয়ে এবং আর্থিক অবস্থা চিন্তা না করে প্রকল্পগুলো নিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিকল্পনার ঘাটতি থাকায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।