শিকারিদের তৎপরতায়  হুমকিতে বন্য প্রাণী 

শিকারিরা সুন্দরবনের গহিনে গাছের ফাঁকে ফাঁকে নাইলনের দড়ির ফাঁদ পেতে রাখে। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো ফাঁদে আটকে যায়।

সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘ–হরিণসহ কয়েক প্রজাতির বন্য প্রাণীর সংখ্যা কিছু বেড়েছে বলে দাবি করছে বন বিভাগ। বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় লোকজন বলছেন, হাতে গোনা কয়েকটি প্রজাতির বন্য প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু শিকারিদের অপতৎপরতার কারণে হরিণসহ অন্য বন্য প্রাণীর সংখ্যা বাড়ার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বন বিভাগের কর্মীদের বিরুদ্ধেও আছে নানা অভিযোগ।

এমন পরিস্থিতিতে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস ঘোষণা করা হয়।

সুন্দরবনের বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকাগুলোয় শিকারিরা অনেক শক্তিশালী। এদের বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। শুধু কয়রা উপজেলাতেই রয়েছে ৩০টির মতো শিকারি দল। তাদের ধরতে সুন্দরবন–সংলগ্ন লোকজন খুব একটা সহযোগিতা করে না। মানুষ সাক্ষ্য দিতেও ভয় পায়। তারা এ সুযোগ নিয়ে আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে। এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ একা বন বিভাগের পক্ষে সম্ভব নয়। ভালো-মন্দ সব জায়গায়ই আছে। সবাইকে সচেতন হতে হবে।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ ও ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী রয়েছে। ২০১৮ সালে বাঘ ছিল ১১৪টি। বর্তমানে বাঘশুমারি চলছে। এবার শুমারিতে বাঘের সংখ্যা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। 

২০২৩ সালের শুমারি অনুযায়ী বনে চিত্রা হরিণ, বন্য শূকর ও বানরের সংখ্যা বেড়েছে। বনে ২০০৪ সালে চিত্রা হরিণ ছিল ৮৩ হাজার। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টিতে। বন্য শূকর ২০০৪ সালে ছিল ২৮ হাজার, ২০২৩ সালে ছিল ৪৭ হাজার ৫১৫টিতে। ২০০৪ সালে বানর ছিল ৫১ হাজার, ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৪টিতে। 

■ সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার।   ■ এর মধ্যে ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ ও ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী রয়েছে। 

বর্তমানে বনে গুইসাপ রয়েছে ২৫ হাজার ১২৪টি ও শজারু ১২ হাজার ২৪১টি। ২০২৩ সালের আগে কখনো এ দুটি প্রাণীর শুমারি হয়নি। তবে আশির দশকে মায়া হরিণ ছিল ২ হাজার ২৬৫টি। ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮৭টিতে। কমেছে দুই প্রজাতির ডলফিনও। ২০০৬ সালে বনের নদীতে ছিল ৪৫১টি ইরাবতী ডলফিন ও ২২৫টি শুশুক। ২০১৯ সালে ইরাবতী ডলফিন ১১৩টি ও শুশুক ছিল ১১৮টি। 

সুন্দরবন–সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে জানা যায়, কয়েকটি বন্য প্রাণীর সংখ্যা বাড়লেও তা শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে শিকার সহজ হওয়ায় হরিণ হলো শিকারি চক্রের প্রধান টার্গেট।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে অন্তত ৪০ জন শিকারিকে হরিণের মাংস–চামড়াসহ আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫১২ কেজি হরিণের মাংস, একটি জবাই করা হরিণ, পাঁচটি চামড়া ও মাথা উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বনরক্ষীরা যে পরিমাণ হরিণের মাংস উদ্ধার ও শিকারিদের আটক করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি হরিণশিকারিদের হাতে মারা গেছে বলে জানান স্থানীয় লোকজন। 

কয়রা উপজেলার বাসিন্দা ওমর ফারুক জানান, মাছ ধরার পাস নিয়ে বনে ঢুকে হরিণ শিকার করে একশ্রেণির অসৎ লোক। সংঘবদ্ধ শিকারিরা সুন্দরবনের গহিনে গাছের ফাঁকে ফাঁকে নাইলনের দড়ির একধরনের ফাঁদ পেতে রাখে। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো ফাঁদে আটকে যায়। ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে হরিণের মাংস অগ্রিম অর্ডারও নেয় শিকারিরা। আর তাদের আশ্রয় দেয় প্রভাশালীরা। এ কাজে যোগসাজশ আছে বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরও। অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে অবাধে বন্য প্রাণী হত্যার সুযোগ দিচ্ছেন তাঁরা। এ ছাড়া শিকারিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা মাংস গায়েব করে দিচ্ছেন খোদ বন বিভাগের কর্মীরাই। 

একটি ঘটনার তদন্তে নেমে বন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চোরা শিকারিদের যোগসাজশের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত কর্মকর্তা খুলনা জেলা পিবিআইর পরিদর্শক কাজী মোস্তাক আহম্মদ বলেন, সম্প্রতি খুলনার কয়রায় জব্দ করা ১২০ কেজি হরিণের মাংসের মধ্যে ৯৫ কেজিই গায়েব করেছিলেন বনকর্মীরা। এ ছাড়া অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার চেষ্টার সাক্ষ্যপ্রমাণও পাওয়া গেছে বনরক্ষীদের বিরুদ্ধে। এ জন্য বন বিভাগের চার কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আটজনের বিরুদ্ধে গত ফেব্রুয়ারি মাসে কয়রা আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পিবিআই। 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, প্রায়ই বন্য প্রাণী শিকারের খবর পাওয়া যায়। এ ছাড়া সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় সেখানকার তরল বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। জোয়ার-ভাটায় এই বর্জ্য বনে ছড়িয়ে পড়ায় মাটিতে রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ বাড়ছে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্য প্রাণী। পাশাপাশি জাহাজের আলো ও শব্দ প্রভাব ফেলছে বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনযাপনে।