‘আমার বুকের ধনরে গুলি করল, পুলিশ ওদের কিছুই করল না’
গেল বছর গ্রামের বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন দ্বীন ইসলাম (২১)। বাবা অসুস্থ। মাছ শিকারের আয়ে সংসার চলে না। এ জন্য সংসারের হাল ধরতে দ্বীন ইসলাম শুরু করেন দিনমজুরির কাজ। বাবা-ছেলের আয়ে সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করে সংসারে। সবেমাত্র সংসারের হাল ধরা দ্বীন ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে বাবা-মায়ের সামনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
দ্বীন ইসলাম নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নাওড়া এলাকার জেলে বিল্লাত হোসেনের ছেলে। বিল্লাত হোসেনের চাচাতো ভাই রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য মোশাররফ হোসেন। কায়েতপাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের পরিবারের সঙ্গে মোশাররফ হোসেনের বিরোধ দীর্ঘদিনের। গতকাল সেই বিরোধ থেকে হওয়া দুই পক্ষের সংঘর্ষে মোশাররফের হয়ে যোগ দিয়েছিলেন দ্বীন ইসলাম। সংঘর্ষের শুরুতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
দ্বীন ইসলামের মায়ের অভিযোগ, রফিকুল ইসলামের ছোট ভাই রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সদ্য নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের গুলিতে দ্বীন ইসলামের মৃত্যু হয়েছে। তবে মিজানুরের দাবি, ঘটনার সময় তিনি এলাকাতেই ছিলেন না। গ্রামবাসীর সঙ্গে মোশাররফের লোকজনের সংঘর্ষে একজন লোক নিহত হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন।
আজ শুক্রবার দুপুরে নাওড়া এলাকায় যেতেই এলাকাজুড়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যদের তৎপরতা দেখা যায়। বাজার থেকে পূর্বে মোশাররফ হোসেন ও নিহত দ্বীন ইসলামের বাড়ি। দুপুরে দ্বীন ইসলামের বাড়িতে যাওয়ার পথে মোশাররফ হোসেনের বাড়ির সামনে লোকজনের জটলা দেখা যায়। বাড়ির সামনে যেতেই এই প্রতিবেদককে ঘিরে ধরেন তাঁরা। কিশোরেরা, নারী-পুরুষ এগিয়ে এসে পরিচয় জানতে চান। সংবাদকর্মী পরিচয় দিলে তাঁরা প্রশ্ন করেন ‘কোন পক্ষের সাংবাদিক?’ পরে দীর্ঘ আলাপে বাড়ির মুরব্বিরা জানান, অন্তত এক দশক ধরে রফিকুল ইসলাম ও মোশাররফের মধ্যে বিরোধ চলছে। বিরোধের জেরে হওয়া সংঘর্ষের পর অধিকাংশ গণমাধ্যমেই একপেশে খবর হয়। পুলিশের ভূমিকাও থাকে বিতর্কিত। ফলে তাঁরা আর এখন সাংবাদিক ও পুলিশকে বিশ্বাস করেন না।
লোকজনের জটলা ঠেলে দ্বীন ইসলামের বাড়ি যেতেই উঠানে বিল্লাত হোসেনের সঙ্গে দেখা হয়। ছেলে হারানোর শোকে ভেঙে পড়া শরীর নিয়ে বাড়ির উঠানে বসে আছেন। উঠান পেরিয়ে দ্বীন ইসলামদের ছোট্ট আধা পাকা ঘর। প্রায় আসবাবপত্রশূন্য অন্ধকার ঘরে দ্বীন ইসলামের মা ঝরনা বেগম আর জেঠি জাহানারা গড়াগড়ি করে বিলাপ করছেন। তাঁদের চারপাশে গ্রামবাসীর ভিড়। বিলাপ করতে করতেই মূর্ছা যান জাহানারা। প্রতিবেশীরা তখন জাহানারার চোখমুখে পানির ঝাপটা দেন।
বিলাপ করতে করতে ক্লান্ত দ্বীন ইসলামের মা ঝরনা বেগম যেন কথা বলার শক্তিও হারিয়েছেন। ভাঙা গলায় জানান, একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে তিনি বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি আরও জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে খাবার খাচ্ছিলেন দ্বীন ইসলাম। এ সময় মোশাররফ হোসেনের বাড়িতে হইহুল্লোড় শুনে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান দ্বীন ইসলাম। বাড়ির অন্য লোকজনের সঙ্গে মিলে বাড়িতে হামলাকারী রফিকুল ইসলামের লোকজনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। সংঘর্ষের শুরুতেই গুলিবিদ্ধ হন দ্বীন ইসলাম।
ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ঝরনা। বুক চাপড়ে আহাজারি করেন। দুই হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন। ঝরনা বলেন, ‘মিজান আর রফিকের লোক হামলা করল। পুলিশ ওগোরে না আটকাইয়া চুপচাপ থাকল। পুলিশের সামনেই মিজান আমার বুকের ধনরে গুলি করল। আমার বুকের ধন আমার চোখের সামনে ছটফট করল। পুলিশ ওদের কিছুই করল না।’
এ সময় সংঘর্ষ চলাকালীন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়েন বাড়িতে আসা গ্রামের অন্য লোকজনও। তাঁরা জানান, বিকেল চারটায় রফিকুল ইসলামের অন্তত চার শতাধিক সমর্থক শটগান, পিস্তল, রাইফেল, ককটেল, চায়নিজ কুড়াল, রামদা ও টেঁটা নিয়ে মোশাররফ হোসেনের বাড়িতে হামলা চালান। এ সময় মোশাররফ হোসেনের লোকজন দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পাল্টা হামলা চালালে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের সময় নাওড়া পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা সংঘর্ষ না ঠেকিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকেন। পুলিশের সামনেই উভয় পক্ষ গোলাগুলি করলে দ্বীন ইসলাম গুলিবিদ্ধ হন। দ্বীন ইসলাম গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর এলাকার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলে উত্তেজিত লোকজন মোশাররফের বাড়ির পাশের রফিকুল ইসলামের সমর্থক ইউপি সদস্য জসিম উদ্দিনের বাড়িঘরে হামলা চালান। তাঁরা জসিম উদ্দিনের অন্তত চারজন স্বজনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়ির নারী ও শিশুদের মারধর করে বাড়িতে লুটপাট চালান। পরে সন্ধ্যা সাতটায় রূপগঞ্জ থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সময় নাওড়া পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা ছিলেন। তাঁরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। পরে খবর পেয়ে রূপগঞ্জ থানা থেকে তাঁরা ঘটনাস্থলে যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে অন্তত ১২টি শটগানের গুলি ছোড়েন। ওসি দাবি করেন, পুলিশ নির্বিকার থাকার অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা।