৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘড়ির কারিগর সনৎ

সনৎ কুমার সরকার
ছবি: প্রথম আলো

রোববার সকালে ঘুম থেকে উঠেই খুলনায় মানুষ ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির দেখা পেয়েছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই বৃষ্টির রূপও বদলেছে। কখনো খানিক ধরে আসে, তো একটু দম নিয়ে কখনো আবার পড়েছে ঝমঝমিয়ে। আর মাঝেমধ্যে পাগলা হওয়ার উসকানি তো ছিলই।

সকাল নয়টার দিকে শহরের কে ডি ঘোষ রোডের থানার মোড়ে ছাতা মাথায় অনেকে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য যানবাহনের অপেক্ষা করছিল। কেউ কেউ সামান্য অপেক্ষার পরই পেয়ে যাচ্ছিল কাঙ্ক্ষিত যান। আবার ভাড়া নিয়ে দরাদরিতে বনিবনা না হওয়ায় কারও অপেক্ষা বাড়ছিল।

ঠিক মোড়ের ওপর নির্মাণাধীন একটি বহুতল ভবনের নিচে বড়সড় এক রঙিন ছাতার তলে বসে কাজ করছিলেন একজন ঘড়িমিস্ত্রি। মুখে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। চোখে ‘আই গ্লাস’ লাগিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি হাতঘড়ির ত্রুটি ধরার চেষ্টা করছিলেন। বৃষ্টির ঝাপটা মাঝেমধ্যে তাঁর মনোযোগে ছেদ টানছিল। একপর্যায়ে তিনি বৃষ্টির কাছে হার মানলেন। ঘড়ি আর আনুষঙ্গিক সব যন্ত্রপাতি সামনে থাকা ছোট টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে তুলে রাখেন।

ঘড়ির এই কারিগরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁর নাম সনৎ কুমার সরকার। বয়স ৭৩-এর কাছাকাছি। গোপালগঞ্জ সদরের দুর্গাপুর গ্রাম থেকে সনৎ কুমারের বাবা খুলনায় আসেন। সেটা ১৯৬২ সালের কথা। খুলনায় এসে বাবা স্বর্ণের কারিগরের কাজ করতেন। সনতের বাবার মতো ওই সময় খুলনার সোনাপট্টিতে দুর্গাপুর গ্রামের অনেকেই স্বর্ণকারের কাজ করতেন।

সনৎ কুমার যখন খুলনায় আসেন, তখন তাঁর বয়স ১২। শহরের রেলওয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। নবম শ্রেণিতে থাকার সময় পড়াশোনার পাশাপাশি ঘড়ি মেরামতের কাজ শেখা শুরু। কাজ শেখার প্রতি মনোযোগ বেড়ে যাওয়ায় পড়ালেখা আর চালিয়ে যাওয়া হয়নি।

সনৎ কুমার বলছিলেন, বাবার মতো স্বর্ণের কারিগর হতে ইচ্ছা করেনি। সোনার দোকানের অ্যাসিডের ঝাঁজালো গন্ধ ভালো লাগত না। তাই নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে এই ঘড়ির কাজ শিখতে থাকলেন। এর পর থেকে প্রায় ৫৭ বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন। তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর অন্যের ঘড়ির দোকানে কাজ করতাম। ১৯৭৫ সালের দিকে নিজেই দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। ঘড়ি বিক্রির পাশাপাশি মেরামতও করতাম। বছর ১৫ পর দোকানমালিক দোকান ভেঙে ফেলায় ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়।’ তবে নিজের দোকান না থাকলেও পেশা বদলাননি তিনি, ফুটপাতে বেস কাজ করে যাচ্ছেন।

দোকান বন্ধ হওয়ার এক বছর পর সনৎ কুমার পরিবার নিয়ে যশোরের নওয়াপাড়ায় চলে যান। কিছুদিন পর তিনি শহরে ফিরে এলেও স্ত্রী-সন্তান সেখানেই থাকেন। তিনি এখন শহরে কালীবাড়ি এলাকার এক মেসে থাকেন। প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে যান আর ফেরেন শনিবার সকালে। সপ্তাহের বাকি পাঁচ দিনের প্রতিদিন সকাল নয়টায় চলে আসেন তাঁর কাজের জায়গায়। ফুটপাতে টেবিল নিয়ে ঘড়ি সারাতে বসে পড়েন। দুপুরে একটু খাওয়ার বিরতি। এরপর কাজ করেন রাত আটটা পর্যন্ত। রাতে মেসে ফিরে খবরের কাগজ পড়া তাঁর অনেকটা নেশার মতো। ঘড়ি সারাই করে কোনো দিন তাঁর আয় ৩০০ টাকা, আবার কোনো দিন ৫০০ টাকা।

আলাপে আলাপে সনৎ কুমার জানালেন, এখন দিন বদলেছে। মুঠোফোন ব্যবহারের ফলে মানুষ হাতঘড়ি পরা কমিয়েছেন। সময় দেখতে এখন মানুষ আর বাঁ হাতের কবজির দিকে তাকায় না, পকেটে থাকা মুঠোফোনেই এখন ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ডের হিসাব মেলায়। আর বাড়িতে বাড়িতে দেয়ালঘড়ি টাঙানোর রীতি বদলেছে। আগে দম বা চাবি দেওয়া ঘড়ির বদলে এসেছে ব্যাটারিওয়ালা ঘড়ি। অ্যালার্ম দেওয়া টেবিলঘড়ির এখন আর দরকার হয় না। আবার ইলেকট্রনিক ঘড়ি আসার পর থেকে ঘড়ি আরও সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। ঘড়ির বৈচিত্র্য বেড়েছে। মানুষের কেনার ক্ষমতাও বেড়েছে। এখন ঘড়ি নষ্ট হলে তা আর মেরামত না করে মানুষ নতুন ঘড়ি কিনতে চায়। মেরামত খরচ যদি ৩০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে থাকে, তবে তারা কাজটা অনেক সময় করায়। ঘড়িমিস্ত্রিদের সুদিন ফেরার সম্ভাবনা কম হলেও এ কাজ একেবারে বন্ধ হবে না বলে মনে করেন সনৎ।

কাজের মাঝে থাকাটা পছন্দ সনৎ কুমারের। তাই ৭৩ বছর বয়সেও তিনি দিনভর কাজ করে যাচ্ছেন। পরিবারের কাছ থেকে দূরে মেসে থাকছেন। সনৎ কুমার সরকার বললেন, ‘কাজ ছেড়ে থাকাটা কঠিন। তারপর বয়স তো হয়ে গেছে! ছেলেটা ব্রজলাল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে। এখন চাকরি খুঁজছে। ছেলের চাকরি পাওয়ার প্রতীক্ষায় আছি। তখন হয়তো কাজটা ছেড়ে দেব।’