যিনি টক আমকে মিষ্টি জাতে পরিণত করেন

আমগাছে ‘টপ ওয়ার্কিং’-এর কাজ করছেন আবদুল মান্নান। ছবিটি সম্প্রতি মিরসরাইয়ের ভোরের বাজার এলাকা থেকে তোলা
ছবি: ইকবাল হোসেন

স্বাদ নেই বা টক, অথবা গাছ আম ধরার উপযোগী হয়েছে, কিন্তু ধরছে না—এমন সমস্যায় ডাক পড়ে আবদুল মান্নানের। ‘অকেজো’ এমন আমগাছে ‘টপ ওয়ার্কিং’ পদ্ধতির মাধ্যমে জাত পরিবর্তন করেন তিনি। শুরুতে নিজের গাছে পরীক্ষা চালিয়ে সাফল্য পান। এখন আমের জাত পরিবর্তন করতে তাঁর ডাক পড়ে মিরসরাইসহ আশপাশের উপজেলায়ও। আমগাছের ডাক্তার হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন। কৃষি উদ্যোক্তা আবদুল মান্নান মিরসরাই উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের ভোরের বাজার এলাকার আমির হোসেনের ছেলে।

৩৮ বছর বয়সী আবদুল মান্নান মিরসরাইয়ের স্থানীয় স্নাতক (ডিগ্রি) পাস করেছেন। কৃষি বা উদ্ভিদবিজ্ঞানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তাঁর। পুরোদস্তুর এই কৃষি উদ্যোক্তা নিজের বাগানের আমগাছের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এই দক্ষতা অর্জন করেছেন। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা তাঁকে নানাভাবে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন।

আবদুল মান্নানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আমগাছে টপ ওয়ার্কিং হচ্ছে একটি বিশেষ পদ্ধতি, যার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক আমগাছ ৪-৫ ফুট উচ্চতা পেলে কেটে ফেলতে হয়। এরপর কাটা অংশের চারপাশে কচি ঢাল গজায়। এক মাসের মাথায় গজানো সেসব ঢাল থেকে ৪-৫টি রেখে অন্যগুলো ছেঁটে ফেলে বাছাই করা ডালগুলোতে পছন্দসই জাতের আমের সায়ন দিয়ে গ্রাফটিং করতে হয়। এরপর এসব ডাল বড় হতে থাকে। গ্রাফটিং করার এক বছরের মাথায় গাছে ফল আসা শুরু করে। তবে ভালো ফলন পেতে প্রথম বছর মুকুল ছিঁড়ে ফেলতে হয়। এ পদ্ধতিতে একটি গাছে ৫-৭টি ভিন্ন জাতের আম ফলানো সম্ভব।

গতকাল মঙ্গলবার মিরসরাইয়ের সাহেরখালী ভোরের বাজার এলাকায় দেখা হয় আবদুল মান্নানের সঙ্গে। মো. সেলিম নামের এক ব্যক্তির বাড়ির পাশের পুকুরপাড়ের ২০টি আমগাছে টপ ওয়ার্কিংয়ের কাজ করছিলেন আবদুল মান্নান। সেখানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

কী করে শিখলেন এ পদ্ধতি, জানতে চাইলে আবদুল মান্নান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো বইপড়া জ্ঞান নেই। এলাকায় আমার নিজের আমবাগান আছে। চার বছর আগে ঝড়ে একটি গাছ ভেঙে গেলে সে গাছ থেকে নতুন করে গজানো কচি ডালে ভিন্ন জাতের আমের সায়ন গ্রাফটিং করে সফল হয়েছিলাম। এরপর বাড়ির আশপাশের কিছু টক আম হয়, এমন গাছে জাত পরিবর্তন করেও ভালো ফলন পাই। এটি দেখে এলাকায় অনেকেই টপ ওয়ার্কিং পদ্ধতি প্রয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে আমের জাত পরিবর্তন করে দিতে প্রতিদিন ডাক পড়ে আমার। গত তিন বছরে মিরসরাই ও পাশের সীতাকুণ্ড উপজেলায় অন্তত ৪০০ আমগাছের টপ ওয়ার্কিং করে সফলভাবে আমের জাত পরিবর্তন করে দিয়েছি। এ বিষয়ে আরও দক্ষতা বাড়াতে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিচ্ছি।’

মিরসাইয়ের একটি বাগানে ‘টপ ওয়ার্কিং’-এর পর ফলন এসেছে আমগাছে
ছবি: সংগৃহীত।

আবদুল মান্নানকে দিয়ে নিজেদের অনুন্নত জাতের ১০টি আমগাছের জাত পরিবর্তন করিয়েছেন মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক আবুল হোসেন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি দারুণ একটি ব্যাপার। যে গাছগুলোর আম ছিল টক আর পানসে স্বাদের, আবদুল মান্নানের হাতে টপ ওয়ার্কিং করিয়ে জাত পরিবর্তনের পর সেসব গাছে এখন উন্নত জাতের আম ফলছে। এ মৌসুমেও এসব গাছ থেকে আমরা ৫-৬ মণ সুস্বাদু আম পেয়েছি। এমনটা সম্ভব তা আমার জানা ছিল না। মান্নানের এ উদ্যোগ এলাকায় বেশ সাড়া ফেলেছে।’

মিরসরাইয়ের বাসিন্দা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ ভূঞা আবদুল মান্নানকে দিয়ে তার বাড়ির ১২টি আমগাছের টপ ওয়ার্কিং করিয়েছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে হর্টিকালচার সেন্টারে কাজ করার সময় আমগাছে টপ ওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে জাত পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন সীতাকুণ্ড উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাবিবুল্লা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকায় মিরসরাইয়ের আবদুল মান্নানের আমগাছের টপ ওয়ার্কিং করার বিষয়টি আমি জেনেছি। এ বিষয়ে মাঝেমধ্যে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। টপ ওয়ার্কিং আমের জাত উন্নয়নে খুবই কার্যকরী একটি পদ্ধতি। দেশের খুব কম জায়গায় এটি বিস্তার লাভ করেছে। আমি সীতাকুণ্ড উপজেলায়ও এ পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে চাইছি। মান্নানের উদ্যোগটি অবশ্যই অনুকরণীয়।’