বল কুড়াতে গিয়ে স্রোতে ভেসে গেল শিশু হুমায়রা

চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর আনন্দিপুর এলাকায় নালায় পড়ে মারা যায় তিন বছরের শিশু হুমাইরা। নালা থেকে তার লাশ উদ্ধারের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা আবদুর রহমান। আজ সন্ধ্যা ছয়টায়ছবি: সৌরভ দাশ

বল হাতে একটি বাড়ির ফটকের বাইরে খেলছিল তিন বছরের শিশু হুমায়রা। লাগাতার ভারী বর্ষণে সড়কে তখন প্রবল স্রোতে বয়ে যাচ্ছিল বৃষ্টির পানি। খেলতে খেলতে বলটি পানিতে পড়ে গেলে সেটি কুড়িয়ে নিতে যায় হুমায়রা। এরপরই পা পিছলে পড়ে যায় পানিতে। বয়ে যাওয়া পানির টানে মুহূর্তেই সে তলিয়ে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর পাশের একটি নালায় পাওয়া যায় হুমায়রার নিথর দেহ। উদ্ধারের পর হাসপাতালে নিলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

আজ বুধবার বেলা তিনটার দিকে নগরের হালিশহরের আনন্দিপুর এলাকার একটি নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় হুমায়রা। বিকেল পৌনে চারটার দিকে তার মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। পুলিশ জানায়, ফায়ার সার্ভিস লাশ উদ্ধারের পর পুলিশকে বুঝিয়ে দেয়। লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

হুমায়রা স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রহমান ও আসমা বেগম দম্পতির একমাত্র মেয়ে। তার বাবা আবদুর রহমান একটি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানিতে কাজ করেন। আর মা আসমা বেগম একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। হুমায়রা যে ভবনের সামনে খেলছিল, সেখানেই তার মায়ের কর্মস্থল।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে ও ভবনের বাইরে স্থাপন করা সিসিটিভির ফুটেজে হুমায়রার পানিতে ভেসে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। জানা গেছে, দুপুরে মায়ের সঙ্গে ওই ভবনে এসেছিল হুমায়রা। পরে বল হাতে গেটের বাইরে খেলতে দেখা যায় তাকে। একপর্যায়ে পা পিছলে পানিতে পড়লে তলিয়ে যায় সে। তার বলটি পানিতে ভাসতে দেখে দ্রুত নালায় নেমে পড়েন স্থানীয় লোকজন। তার খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে ফায়ার সার্ভিসে ফোন করেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে আসে।

উদ্ধারকাজে ঘটনাস্থলে এসেছিলেন আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের লিডার কামরুল ইসলাম। তাঁর কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, খবর পেয়ে ডুবুরি দলসহ ঘটনাস্থলে আসেন তাঁরা। প্রায় এক ঘণ্টা খোঁজার পর বিকেল চারটার দিকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাঁরা হাসপাতালে নিয়ে যান।

সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, তখনো সড়কে গোড়ালির চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি। হুমায়রা যেখানে পানিতে ভেসে যায়, তার পাশেই মূল সড়কের সঙ্গে একটি নালা রয়েছে। পুরো নালায় স্ল্যাব বসানো। তবে দুটি সড়কের সংযোগস্থলে স্ল্যাব নেই। ভেসে গিয়ে শিশুটি ওই স্থান দিয়েই নালায় তলিয়ে যায় বলে জানান এলাকাবাসী।

এই স্থান দিয়েই নালায় তলিয়ে যায় হুমায়রা। আজ সন্ধ্যা ছয়টায়
ছবি-সৌরভ দাশ

মা-বাবার একমাত্র মেয়ে

মা–বাবার সঙ্গে হুমায়রা আনন্দিপুর জামে মসজিদের বিপরীতে একটি আধাপাকা ঘরে বসবাস করত। এর সামনেই মসজিদ গলিতে নিয়াজ খানের বিল্ডিংয়ে আসমা বেগমের কর্মস্থল। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল হক বলেন, বেলা আড়াইটার দিকে শিশুটির মাকে দেখলাম শিশুটিকে নিয়ে কাজে যেতে। তখন শিশুকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে, জিজ্ঞেস করার পর বলল কাজে যাচ্ছে। পানিতে মেয়েকে নিয়ে বের হওয়ায় তাঁকে সতর্ক করেছিলাম। পরে শুনেছি মেয়েটা নালায় পড়ে মারা গেছে। এলাকার সবাই চেনে তাঁদের। বাবার সঙ্গে দোকানে আসত হুমায়রা।

হুমায়রাদের বাড়িতে ঘুরে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকজন জানান, দাদির বাড়িতে নেওয়া হয়েছে লাশ। সেখানেই আছে তার বাবা আবদুর রহমান। প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে হুমায়রার দাদার বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের একটি কক্ষের মাটিতে নির্বাক হয়ে বসে আছেন আবদুর রহমান। কারও সঙ্গে কথা বলবেন না বলে জানান তিনি।

স্থানীয় কয়েকজন দরজা খুলে ভেতরে যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন আবদুর রহমান। মাটিতে বসেই মেয়ের শোকে আহাজারি করছিলেন তিনি। বিলাপ করে তিনি বলেন, ‘আমি তো কিছুই জানি না। কীভাবে কী হলো! আমি তো কাজে ছিলাম। আমার মেয়েটা কীভাবে কী হয়ে গেল! বল নিয়ে খেলা করতেছিল। কীভাবে পানিতে পড়ল আমার মেয়েটা।’

চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের আনন্দিপুরে যেখানে পানিতে ভেসে যায় শিশু হুমায়রা, সেখানে সন্ধ্যায়ও ছিল পানি
সৌরভ দাশ

তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি

এদিকে ঘটনার জন্য সিটি করপোরেশনকে দুষছেন স্থানীয় বাসিন্দা। তাঁদের দাবি, সড়কের অধিকাংশ স্থানে স্ল্যাব তুলে কাজ চলছে নালার। রাস্তাও ঠিক নেই। বর্ষায় প্রতিবছর পানি থাকে।

এর মধ্যে সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন ও প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। এ সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা।

করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিশুর দাফনের জন্য পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তাঁরা কাল প্রতিবেদন জমা দেবেন।

নালায় পড়ে মৃত্যু চট্টগ্রাম নগরে এবারই প্রথম নয়। গত ছয় বছরে নগরে খাল-নালায় পড়ে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে নগরের চাক্তাই খাল থেকে উদ্ধার করা হয় নিখোঁজ থাকা শিশু সেহরিশের নিথর দেহ। আগের দিন রাত আটটার দিকে কাপাসগোলার হিজড়া খালে তলিয়ে যায় সে।