সুন্দরবনের ‘বাঘবিধবা’

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পাঁচ বাঘবিধবা। গত পয়লা এপ্রিলছবি: প্রথম আলো

বন-বাঘ, মধু-মাছ ছাড়া যাঁদের জীবনে কোনো গল্প নেই, তাঁদের কথার চেয়ে কান্নাই বেশি। সাতক্ষীরার দাতিনাখালী গ্রামের আমিরন বিবির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তা-ই মনে হয়েছে। তাঁর স্বামীকে বাঘে ধরার এক বছরের মধ্যেই বাঘে ধরেছে তাঁর ছেলেকে। স্বামী-সন্তান হারানোর এই দুঃখ বুকে নিয়ে ২৩ বছর ধরে কখনো নদীতে জাল টানেন, কখনো মানুষের বাড়িতে কাজ করেন। এভাবেই পাঁচ মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে আছেন। তাঁরা ঢাকায় থাকেন। আমিরন বিবির সঙ্গী শুধুই চোখের জল। তিনি সুন্দরবনের ‘বাঘবিধবা’।

আমিরন বিবির সঙ্গে গত ১ এপ্রিল কথা হয়েছিল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। সেদিন ছিল সুন্দরবনের মধু আহরণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। বন বিভাগের এ অনুষ্ঠানে মৌয়াল-চাষি-বণিক-গবেষক ও ভোক্তার জাতীয় জোট ‘মৌমাছি ও মধু’ বাঘবিধবাদের কিছু সহায়তার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেখানে যে পাঁচ বাঘবিধবা এসেছিলেন, তাঁদের একজন আমিরন বিবি। মৌমাছি ও মধুর সংগঠকেরা এই বাঘবিধবাদের নাম বদলে ‘বাঘশহীদ পরিবার’ বলে ঘোষণা দেন। তাঁদের ভাষ্য, বাঘশহীদ সম্বোধনটা বাঘবিধবার চেয়ে একটু সম্মানজনক।
বুড়িগোয়ালিনী বিদ্যালয় মাঠে কথা শেষে আমিরন বিবি বললেন, ‘না খাইয়া বেড়াই। আপনারা ভালো থাইকো, আবার আইসো।’

২০১৪ সাল পর্যন্ত বাঘবিধবাদের জন্য তাদের একটি প্রকল্প ছিল। ওই সময় পর্যন্ত শুধু কয়রা ও শ্যামনগর উপজেলায় তাঁরা ৬০০ জন বাঘবিধবা পেয়েছিলেন।
বেসরকারি সংস্থা ‘লিডার্সের’ প্রশাসনিক কর্মকর্তা জয়দেব কুমার

১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই সুন্দরবনের ৬৬ শতাংশ বাংলাদেশের সাতক্ষীরার, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় আর বাকি অংশ পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায়। দুই দেশেই বাঘবিধবাদের সঠিক কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। বেসরকারি সংস্থা ‘লিডার্সের’  প্রশাসনিক কর্মকর্তা জয়দেব কুমার জানান, ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাঘবিধবাদের জন্য তাদের একটি প্রকল্প ছিল। ওই সময় পর্যন্ত শুধু কয়রা ও শ্যামনগর উপজেলায় তাঁরা ৬০০ জন বাঘবিধবা পেয়েছিলেন।

ভারতের সুন্দরবন গবেষক উজ্জ্বল সরদার ও যোগমায়া সরদার দম্পতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সাল পর্যন্ত তাঁরা ভারতের অংশে আড়াই হাজার বাঘবিধবা পেয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি।    

হিসাব আর পরিচয় যা-ই হোক, এই হতাশাগ্রস্ত পরিবারের জন্য কেউ বড় কিছু করেনি। বাংলাদেশে বাঘবিধবা পরিবারের জন্য ২০১২ সাল থেকে ১ লাখ টাকা ও ২০২১ সাল থেকে ৩ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সুন্দরবন পশ্চিমের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাসের মহসিন হোসেন জানান, আগের চেয়ে বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যু অনেক কম। তাঁরা এ পর্যন্ত ৬৫ জনকে অনুদান দিয়েছেন।

বাঘবিধবা খোদেজা বিবির বাড়িও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালী গ্রামে। ২০১০ সালে তাঁর স্বামী আবদুল আজিজ সানাকে বাঘে ধরেছিল। খোদেজা এখন নদীতে জাল টেনে মাছের পোনা ধরেন। এভাবেই সংসার চালান। সংসারে ছেলের দুই ছেলেমেয়ে, বউ আছে। ছেলে কোনো কাজ করতে পারে না। স্বামীর প্রসঙ্গ আসতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘যেখানে ধরিল, সেখানে যাতিই সন্ধ্যা হইল। মানুষ যাইয়া নিয়ে আইলো। হাঁটুটা বাঘে ছাড়াইয়া ফেলিল।’

মনজিলা বেগমের বাড়ি শ্যামনগর উপজেলার ভামিয়া গ্রামে। তাঁর স্বামী আবু হাসান ঢালীকে ২০০৮ সালে বাঘে ধরে। সংসার কীভাবে চলে, সেই প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘গাঙ্গে জাল টানি।’

জামিলা বেগমের বাড়িও ভামিয়া গ্রামে। তাঁর স্বামী আবদুল লতিফ ঢালীকে ২০০৩ সালে বাঘে ধরে। তাঁর তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। তিনিও  বললেন, ‘ছেলেরা খাইতে দেয় না। গাঙ্গে জাল টানি।’

কথা বলে জানা যায়, জাল টানার মানে নদীতে জাল দিয়ে চিংড়িপোনা ধরা। একটা পোনা ৫০ পয়সা, ১ টাকা, কখনো ২ টাকায় বিক্রি হয়। সারা দিনে হয়তো ১০০-২০০ টাকার ব্যবস্থা হয়।

আগের চেয়ে বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যু অনেক কম। তাঁরা এ পর্যন্ত ৬৫ জনকে অনুদান দিয়েছেন।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাসের মহসিন হোসেন

তাঁদের কথা শুনে শুধুই মনে হতে লাগল, এই মৃত্যুভয় জেনেও কেন মানুষ বনে যান। হাতের কাছেই পাওয়া গেল স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তার হোসেন গাজীকে। তাঁকে ১৯৯১ সালে বাঘে ধরেছিল। তিনি বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে এসেছেন। ছয় মাস চলে তাঁর চিকিৎসা। তারপর থেকেই বনে যান।

জানা গেল, এর আগে মৌয়ালদের নৌকায় একজন করে গুনিন থাকত। গুনিন দোয়া পড়ে নৌকায় উঠতেন। বিনিময়ে আহরিত মধুর সমান ভাগ গুনিনকে দিতে হতো। মুক্তার হোসেন বললেন, এখন আর কেউ গুনিন সঙ্গে নেন না। কারণ, তাতেও রক্ষা হয় না। বেশির ভাগ গুনিনকেই বাঘে খেয়েছে।

কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনের বাঘবিধবাদের নিয়ে কাজ করে। বাঘের আক্রমণের শিকার মৌয়ালদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ চিকিৎসক রয়েছে। আহত ব্যক্তিরা হাসপাতালে না গিয়ে তাঁর কাছেই যান। এমন একজন চিকিৎসকের নাম এস এন সোলাইমান হোসেন (৬৫)। তাঁর বাড়ি শ্যামনগরে ছোট ভেটখালি গ্রামে। কথা হলো তাঁর সঙ্গেও। এই চিকিৎসকের দাবি, তিনি বাঘের হামলায় আহত অন্তত ১০০ জন মৌয়ালের চিকিৎসা দিয়েছেন। তাঁর দাবি, তাঁর চিকিৎসায় সবাই সুস্থ হয়েছেন।

সেদিন শ্যামনগরে তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহীতে তখনো শীতের আমেজ। হঠাৎ গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এরই মধ্যে চোখে পড়ল সুন্দরবনঘেঁষা নদীতে কয়েকজন নারী সেই জাল টানছেন। এই জাল টেনে পোনা ধরা আর বাঘের সঙ্গে লড়াই করে গোলপাতা, মধু আহরণ একই রকম শ্রমসাধ্য কাজ। সুন্দরবন ও এর আশপাশের মানুষগুলো দুমুঠো ভাতের জন্য যুগ যুগ ধরে এমন লড়াই করে চলেছেন।