আলিমুদ্দিনের ‘শান্ত বাবু’র গতি করলেন গ্রামবাসী

আলিমুদ্দিন গত কোরবানির ঈদের সময় এই ষাঁড়ের দাম হেঁকেছিলেন ১২ লাখ টাকা। তাঁর বাড়ি পুঠিয়া উপজেলার কান্দ্রা গ্রামে।

রাজশাহী জেলার মানচিত্র

শেষ পর্যন্ত আলিমুদ্দিনের শান্ত বাবুকে (ষাঁড়) চোখের জলেই বিদায় দিতে হয়েছে। গত তিন ঈদে এত বড় গরুর গ্রাহক মেলেনি। গতকাল বুধবার তাই শান্ত বাবুকে গ্রামের লোকজনের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাঁরা জবাই করে মাংস ভাগ করে নিয়েছেন।

বিক্রয়মূল্য নয়, মাংসের দাম হিসেবে আলিমুদ্দিনকে তাঁরা পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন। আর এক লাখ টাকা পরে দিতে চেয়েছেন। আলিমুদ্দিন গত কোরবানির সময় এই ষাঁড়ের দাম হেঁকেছিলেন ১২ লাখ টাকা। তাঁর বাড়ি পুঠিয়া উপজেলার কান্দ্রা গ্রামে।

শরৎ চন্দ্রের ‘মহেশ’–এর মতোই গল্পের গফুর নিজে না খেয়ে মহেশকে খাওয়াতেন। আলিমুদ্দিনও শেষ সম্বল দেড় বিঘা জমি বন্ধক রেখে ষাঁড়টি পুষেছেন। শখ করে নাম রেখেছিলেন শান্ত বাবু। নিজের গাভির পেট থেকে বাড়িতেই সাড়ে চার বছর আগে এই ষাঁড়ের জন্ম হয়েছিল।

তাঁর বাড়িতে এত বড় ষাঁড় কোনো দিন হয়নি। তাই শখ করে আলিমুদ্দিন পুষেছিলেন। দেখতে চেয়েছিলেন ষাঁড়টি কত বড় হয়। দেখতে দেখতে তিনি বিপদে পড়ে যাবেন, তা বুঝতে পারেননি।

আলিমুদ্দিনের ভাষ্য, তিনি গরুকে বাজারের ‘ফিড’ খাওয়াননি। মসুর, খেসারি ও ছোলা কলে ভাঙিয়ে নিয়ে এসে খড়ের সঙ্গে মিশিয়ে নিজে খাবার তৈরি করেন। এর আগে প্রতিদিন শান্ত বাবুর পেটে যেত ১ হাজার ১০০ টাকা। গত বছর তা বেড়ে হয়েছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু সেবার গরু বিক্রি করতে না পেয়ে আলিমুদ্দিন ভেঙে পড়েন। এ বছর ষাঁড় বিক্রি করতে না পেরে তিনি খাবারের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছিলেন। মাংসের দামে ষাঁড় দিয়ে তিনি তার খরচটা তুলতে চেয়েছিলেন। সেটিও ষোলআনা উঠে আসেনি। গত কোরবানির ঈদের আগে তিনি ষাঁড়ের গুঁতা খেয়ে মরতে বসেছিলেন।

আলিমুদ্দিন জানান, তাঁর গরুর মাংস যেমন গ্রামের মানুষের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে তেমনি তার এ টাকাও ভাগ হয়ে মানুষের কাছেই চলে যাবে। বন্ধকী জমি ছাড়াতে হলে দুই লাখ টাকা লাগবে। পুরোটা তিনি একসঙ্গে দিতে পারবেন না। এক লাখ টাকা দিয়ে অর্ধেক জমি ছাড় করাবেন। বাকি টাকা দিয়ে অন্যান্য মানুষের ধারদেনা মেটাতে হবে।

আফসোস করে আলিমুদ্দিন বলেন, তিনি জীবনে বড় একটা ভুল করেছেন। তাঁর মতো সহায়–সম্বলহীন মানুষ যেন শখ করে এত বড় গরু পুষতে না যায়। তাঁর মতো ভুল যেন দ্বিতীয় কেউ না করেন। যাঁদের আর্থিক সঙ্গতি আছে, তারা খামার

করবেন, লাভবান হবেন। তিনি বলেন, তাঁর বড় ছেলেটা মৌসুমি ব্যবসা করে। তাই তাঁরা খেয়ে–পরে বেঁচে আছেন।

৯৬ বছর আগে লেখা শরৎ চন্দ্রের গল্পের সঙ্গে কোথায় যেন আলিমুদ্দিনের বাস্তবতা মিলে যায়। গফুর মহেশের মাথায় আঘাত করে চিরতরে তার ক্ষুধার জ্বালা মিটিয়েছিলেন। গ্রামবাসীর হাতে তুলে দিয়ে নিজে ষাঁড়ের হাত থেকে আলিমুদ্দিনও যেন নিষ্কৃতি পেলেন। কিন্তু কিছু দায়–দেনার ভার তাঁকে বয়ে বেড়াতে হবে।

আলিমুদ্দিনের অবস্থা দেখে গত বছর কান্দ্রা গ্রামের বাসিন্দা পল্লী বিদ্যুতের ঠিকাদার এনামুল হক গরুটি চাঁদা তুলে নিজেরা কিনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। সে সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘লোকটা শখ করে গরু পুষে বেকায়দায় পড়েছেন। এটা ভেবেই তিনি গ্রামের মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন।

যদি এক হাজার টাকা কেজি পড়ে, তবু তাঁরা চাঁদা তুলে ভাগাভাগি করে গরুটি কিনে নেবেন। লোকটা বাঁচবে। গ্রামের মানুষের একটি বড় গরুর মাংস খাওয়ার সুযোগ হবে।’ কিন্তু পরে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। তা নিয়ে আলিমুদ্দিন কিছু মনে করেননি। তিনি বলেন, মানুষ বিপদে পড়লে এভাবেই সান্ত্বনা দেয়। তাই হয়েছে।

এবার আশরাফুল নামের এক ব্যক্তি উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছেন।