দল বেঁধে সমুদ্রে নামল বালুতে জন্ম নেওয়া ২৭০টি কাছিমের বাচ্চা

কক্সবাজারের রামুর প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতে দল বেঁধে সমুদ্রের পানিতে ছুটছে দুই দিন বয়সী কাছিমের বাচ্চা
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতের বালুচরে আড়াই মাস আগে শতাধিক ডিম পেরেছিল একটি অলিভ রিডলে প্রজাতির মা কাছিম। পরিবেশকর্মীরা বালুচর থেকে ডিমগুলো সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করেন। দুই দিন আগে বালুর নিচে রাখা সেসব ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে শুরু করে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করা কাছিমের ডিম থেকে জন্ম নেওয়া ২৭০টি বাচ্চা গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সমুদ্রে অবমুক্ত করা হয়েছে।

প্যাঁচারদ্বীপে কাছিমের ডিম সংরক্ষণের হ্যাচারি পরিচালনা করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নেকম। গতকালের ২৭০টি কাছিমের বাচ্চা অবমুক্তকরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার, কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সরওয়ার আলম, নেকম ইকোলাইফ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক শফিকুর রহমান, ইকোলাইফ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল কাইয়ূম প্রমুখ।

সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, ডিম পাড়তে এসে বহু মা কাছিম নিষিদ্ধ জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে তিনি অন্তত ১০টি মরা কাছিম পরীক্ষা করে শরীরের আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন। আবার বালুচরে জন্ম নেওয়া বাচ্চাগুলোও অবমুক্ত করার পর গভীর সাগর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না উপকূলজুড়ে নিষিদ্ধ জাল পুঁতে রাখার কারণে। কাছিম সংরক্ষণে সৈকতে পর্যটকবাহী বিচ বাইকের চলাচল বন্ধ, ডিম পাড়ার স্থানগুলো সংরক্ষণ, রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো ও ক্যাম্প ফায়ার বন্ধ, শব্দ ও পরিবেশদূষণ রোধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

তিন হ্যাচারিতে আরও ৭ হাজার ২৫৮ ডিম

নেকম কর্মকর্তা শফিকুর রহমান বলেন, প্যাঁচারদ্বীপের একটি হ্যাচারিতে ১৮টি কাছিমের ২ হাজার ৩০টি ডিম সংরক্ষণ করা আছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত কাছিমগুলো এ সৈকতে ডিম পেড়ে বালুতে গর্ত খুঁড়ে চাপা দিয়েছিল। কুকুর, গুইসাপ কাছিমের ডিম খেয়ে ফেলে এবং মানুষও ডিম চুরি করে বাজারে বিক্রি করেন। এ কারণে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে বালুচর থেকে ডিমগুলো সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করা হয়। প্রথম দফায় গতকাল বৃহস্পতিবার ২৭০টি কাছিমের বাচ্চা সমুদ্রে অবমুক্ত করা হলো। অবশিষ্ট ১ হাজার ৭৬০টি ডিম থেকেও সহসা বাচ্চা ফুটবে। তখন এসব বাচ্চাও সমুদ্রে অবমুক্ত করা হবে।

কক্সবাজারের প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতের বালুতে জন্ম নেওয়া কাছিমের দুই দিন বয়সী বাচ্চা
ছবি: প্রথম আলো

নেকমের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, নেকম-ইকোলাইফ প্রকল্পের আওতায় টেকনাফে বাহারছড়ার শিলখালী ও শাহপরীর দ্বীপে আরও দুটি হ্যাচারিতে কাছিমের ডিম সংরক্ষণ করা হচ্ছে। শিলখালীর হ্যাচারিতে ৯টি কাছিমের ১ হাজার ২৩৯টি ডিম ও শাহপরীর দ্বীপের হ্যাচারিতে ৩১টি কাছিমের ৪ হাজার ২৫৯টি ডিম আছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে তিনটি হ্যাচারিতে ডিম আছে ৭ হাজার ২৫৮টি।

গড়ে ৬০ দিনের মধ্যে কাছিমের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় এবং বাচ্চাগুলো নিজে নিজেই গভীর সাগরের দিকে পাড়ি জমায় বলে জানান নেকমের উপপ্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, পুরুষ কাছিম জন্মের পর দ্বিতীয়বার আর জন্মস্থান সৈকতে ফিরে আসে না। পুরো জীবনচক্র সাগরেই কেটে যায়। তবে স্ত্রী কাছিম ডিম পাড়তে হাজার মাইল দূর থেকে নির্জন সৈকতের বালুচরে ছুটে আসে। প্রজাতিভেদে কাছিমের গড় আয়ু ৫০ বছর। সামুদ্রিক আগাছা, ময়লা-আবর্জনা, ছোট মাছ ও জেলি ফিশ খেয়ে বাঁচে সামুদ্রিক কাছিম। বিশ্বব্যাপী সাত প্রজাতির কাছিমের বিচরণ দেখা গেলেও কক্সবাজার উপকূলে অলিভ রিডলে প্রজাতির কাছিম বেশি দেখা যায়। হ্যাচারিতে সংগ্রহ করার ডিমগুলো অলিভ রিডলে প্রজাতি কাছিমের।

নেকমের তথ্যমতে, অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে তাঁদের ডিম সংগ্রহ বেড়েছে। ২০২১ সালে নেকম ৪১টি কাছিমের ৪ হাজার ৩১৩টি ডিম সংগ্রহ করেছিল। হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করে ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফুটেছিল ৪ হাজার ১৬৭টি। সব কটি বাচ্চা তখন সাগরে অবমুক্ত করা হয়েছিল।

কক্সবাজারের প্যাঁচারদ্বীপ সৈকতে ডিম পেড়ে সমুদ্রে ফিরে যাচ্ছে অলিড রিডলে প্রজাতির একটি কাছিম
ছবি: প্রথম আলো

২০২২ সালে ৪৯টি কাছিমের ৫ হাজার ৭৬৩টি ডিম হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করে বাচ্চা ফুটেছিল ৪ হাজার ৮৬০টি। আর ২০২৩ সালের আড়াই মাসে ৫৮টি কাছিমের ৭ হাজার ৫২৮টি ডিম হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আগামী এপ্রিল পর্যন্ত কাছিমের ডিম পাড়ার সময় রয়েছে। এ সময় আরও কিছু ডিম সংগ্রহ হতে পারে জানিয়ে নেকমের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল কাইয়ূম বলেন, সমুদ্রে থাকা কাছিমের পায়ের আঙুলগুলোর মধ্যে বুনট চামড়ার জাল থাকে, কিন্তু স্থলে বাস করা কচ্ছপের এ রকম থাকে না। যে কারণে কচ্ছপ মাটিতে হাঁটতে পারলেও কাছিম পারে না। কাছিম ডিম পাড়ার সময় বালুতে গর্ত খুঁড়ে ডিম পাড়ে এবং দ্রুত বালু দিয়ে ডিমগুলো ঢেকে দিয়ে পুনরায় সমুদ্রে নেমে পড়ে। গড়ে ৬০ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।

মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, টাকার লোভে অনেকে কাছিম ধরে খোলস ছিঁড়ে বিক্রি করে। কাছিমের মাংসও বিক্রি হচ্ছে খাওয়ার জন্য। মাছ ধরার জালে কাছিম আটকা পড়লে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। সৈকতে মানুষের উৎপাত, হইচই, আলোকসজ্জা ও বিচ বাইকের চলাচলে কারণে কাছিম ডিম পাড়তে পারছে না। বিশেষ করে ডিম পাড়ার প্রধান অঞ্চল সেন্ট মার্টিন দ্বীপে এ পর্যন্ত একটি কাছিমের ডিমও সংগ্রহ করা হয়নি। অথচ সেখানকার পরিবেশ ডিম পাড়ার অনুকূলে।