চার মাসে প্রাণ গেছে ছয়জনের

  • হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচতে সরকারের পদক্ষেপ চেয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

  • হাতির দলকে পাহাড়ে ফিরিয়ে দিতে এলিফ্যান্ট রেসপন্স দলের সদস্যরা কাজ করছেন।

শেরপুর জেলার মানচিত্র

‘আমগর মতো অসহায় নাই। আমগর জায়গাজমি কিছুই নাই। অন্যের জমিতে কোনোরহম থাহি। স্বামী ঝাল–মুড়ি বিক্রি কইরা কোনোরহম সংসার চলাইতো। অহন হেই মানুষটাও নাই। ছয় ছেলে–মেয়ের মধ্যে একজন বাক্‌প্রতিবন্ধী, আরেকজনের বয়স তিন বছর, আরেক মেয়ের অহনও বিয়া অইছে না। দুই মেয়ে ও এক ছেলে বিয়া কইরা আলাদা সংসার করে। অহন তিন সন্তান লইয়া কেমনে চলমু। কী খাওয়াইমু, অহন আমগরে কেডা দেখবো। আত্তি (হাতি) আমার সব শেষ কইরা দিছে।’

কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার কড়ইতলী গ্রামের বন্যহাতির আক্রমণে নিহত গোলাপ হোসেনের স্ত্রী আমেনা খাতুন (৪৮)। হাতির আক্রমণে প্রায়ই ঘটছে এমন হতাহতের ঘটনা। গত মঙ্গলবার রাতে বন্যহাতির আক্রমণে গোলাপ হোসেন নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এর এক দিন পর বৃহস্পতিবার সকালে কড়ইতলী শালবনে আম কুড়াতে গিয়ে হাতির আক্রমণে কোরবান আলী (৬০) নামে ঠেলাচালকের মৃত্যু হয়। গত শনিবার দুপুরে কড়ইতলী সীমান্তের শালবনের গভীর জঙ্গল থেকে তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।

হাতির আক্রমণে নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই পরিবারের উপার্জনকারী ছিলেন। এখন পরিবারগুলো অর্থনৈতিকভাবে বিপাকে পড়েছে।

এ ছাড়া গত ১২ মে উপজেলার সীমান্তবর্তী ধোপাজুরি পাহাড়ের ঢালে হাতির আক্রমণে আলতাফ উদ্দিন (৭০) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়। ২৫ এপ্রিল রাতে নালিতাবাড়ীর বাতকুচি পাহারটিলা গ্রামে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে ওমর আলী (৫০) নামের আরেক কৃষকের মৃত্যু হয়। ৩০ মার্চ নাকুগাঁও পাহাড়ের ঢালে বোরো ধান পাহারা দিতে গিয়ে বন্যহাতির তাড়া খেয়ে উসমান আলী (২৮) ও ৫ মার্চ হালুয়াঘাটের মহিললেটি এলাকায় সীমান্তবর্তী পাহাড়ের ঢালে রাতে শশাখেতে সেচ দিতে গিয়ে হাতির আক্রমণে সাইফুল ইসলাম (৩৫) নামের দুই কৃষকের মৃত্যু হয়।

সব মিলিয়ে চার মাসের ব্যবধানে দুই উপজেলায় হাতির আক্রমণে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন। এখন পরিবারগুলো অর্থনৈতিকভাবে বিপাকে পড়েছে। হাতির আক্রমণ থেকে বসতবাড়ি ও ফসল রক্ষায় সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

কড়ইতলী গ্রামের বাসিন্দারা জানান, কড়ইতলী শালবন এলাকায় এক সপ্তাহ ধরে ৪০–৪৫টি বন্য হাতি অবস্থান করছে। এ দলে পাঁচ থেকে সাতটি হস্তীশাবকও আছে। দিনে বনে দেখা গেলেও সন্ধ্যা নামার পরপর এসব হাতি খাবারের সন্ধানে নেমে আসছে লোকালয়ে।

নিহত গোলাপ হোসেনের স্ত্রী আমেনা খাতুন বলেন, ‘আমরা অন্যের বাড়িতে পাহারাদার হিসেবে বসবাস করি। আমার স্বামীই একমাত্র উপার্জন করত। অহন কেমনে কী করমু।’

নিহত কোরবান আলীর ছেলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বাবার মৃত্যুতে মা প্রায় পাগল হইয়া গেছে। শুধু আবুল তাবুল বকতাছে। বাবার মৃত্যুতে আমগর সংসারে বিরাট ক্ষতি হইয়া গেল। সরকার যদি এই বিষয়ে একটু নজর দিত, তাহলে সীমান্তবাসী একটু স্বস্থি পাইত।’

ময়মনসিংহ বন বিভাগের গোপালপুর বিট কর্মকর্তা লোকমান হাকিম প্রথম আলোকে জানান, হাতির আক্রমণে হালুয়াঘাটে চার ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় দুজনের পরিবারের পক্ষ থেকে বন বিভাগে আবেদন করেছেন। সম্প্রতি নিহত দুই পরিবারকে আবেদন করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্তদেরও আবেদন করতে বলা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রত্যেক পরিবার ৫০ হাজার করে টাকা পাবে।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা রেঞ্জ কমকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাতির দলকে পাহাড়ে ফিরিয়ে দিতে এলিফ্যান্ট রেসপন্স দলের সদস্যরা কাজ করছেন। সম্প্রতি দুজন নিহত ব্যক্তির পরিবার বাদে বাকিদের আবেদন বন বিভাগে পাঠানো হয়েছে।