বরেণ্যদের বাড়ি সংরক্ষণের দাবি
স্মৃতির শহর রাজশাহী
সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) রাজশাহীর সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, রাজশাহী নগরকে যেভাবে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে, সেভাবে শহরের ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে শহরটির ঐতিহাসিক মূল্য রক্ষা পাবে। পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা বিকশিত হবে।
‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই...বাবুই হাসিয়া কহে—‘তবু ভাই, পরের ও বাসা, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।’ ‘স্বাধীনতার সুখ’ এই কবিতার জন্য অমর হয়ে আছেন কবি রজনীকান্ত সেন। তাঁর স্মৃতিধন্য বসতবাড়িটা এখনো আছে রাজশাহী শহরে। প্রায় শতবর্ষ আগে কাজী নজরুল ইসলাম এই বাড়ি ঘুরে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।
কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িও আছে এ শহরে। আরও আছে উপমহাদেশের বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস চর্চার পথিকৃৎ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদুনাথ সরকার ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা কুমার শরৎকুমার রায়ের অমূল্য স্মৃতি। এসবের অনেক কিছুই বেদখল হয়ে যাচ্ছে। বিখ্যাত মানুষের বাড়িগুলো হয়ে উঠতে পারে রাজশাহীর দর্শনীয় স্থান। এখন প্রয়োজন শুধু সংরক্ষণের।
আজ থেকে আট বছর আগে কলকাতার সংগীত পরিচালক দিলীপ কুমার রায় রাজশাহীতে এসেছিলেন। তিনি ছুটে গিয়েছিলেন কবি রজনীকান্ত সেনের বাড়িতে। রজনীকান্ত ছিলেন তাঁর নানা। নগরের সাহেববাজার এলাকার ওই বাড়ি থেকে ফেরার সময় দিলীপ ওই ভিটা থেকে ইটের দুটো টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে যান।
ইতিহাসবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীরা বলেন, রজনীকান্ত সেনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল রাজশাহীর বোয়ালিয়া জিলা স্কুলে (বর্তমান রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল)। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে ১৮৯১ সালে তিনি বি.এল পাস করে রাজশাহীতে ওকালতি শুরু করেন। সে সময় ২৭ শতাংশ জমি কিনে ওই বাড়ি করেছিলেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। কবির মৃত্যুর পর ফাঁকা পড়ে থাকে ‘আনন্দ নিকেতন’ নামের ওই বাড়ি।
দেশভাগের পরে তাঁর বাড়িটি রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালে জেলা প্রশাসন বাড়িটি সোনালী ব্যাংককে বরাদ্দ দেয়। এখন বাড়িটি সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী করপোরেট শাখার পাসপোর্ট বুথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সংস্কার করার কারণে পুরোনো বাড়ির ঘরগুলো আর আগের মতো নেই। এখন বাড়িটিতে পাঁচটি ঘর রয়েছে। সামনে একটি বারান্দা। মূল বাড়িতে ঢোকার জন্য বারান্দার সঙ্গে দুটি দরজা। ব্যাংকের কাগজপত্র রাখা দুটি ঘর তালাবদ্ধ। একটি ঘর ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দাপ্তরিক কাজে। এক ঘরে থাকেন আনসার সদস্যরা, অন্যটি ব্যবহৃত হয় রান্নার কাজে।
বাড়ির পেছনে উঁচু ভিটা। শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলায় ঢিবির মতো উঁচু হয়েছে। এসব ছাপিয়ে ঝোপঝাড় উঠেছে। ‘আনন্দ নিকেতন’ নামটি আর কোথাও লেখা নেই। তবু বাইরে থেকে অনেকেই এই বাড়ি দেখতে এসে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন।
এলাকার সংস্কৃতিকর্মীরা আরও বলেন, কবির লেখা ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই। দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নেই’ গানটি স্বদেশি আন্দোলনকালে বাঙালিদের তাতিয়ে তুলেছিল। মানুষ বিদেশি পণ্য বর্জনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সেই সময়ে রজনীকান্তের নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে। তাই তো ১৯২৮ সালে রাজশাহী এসে কাজী নজরুল ইসলাম রজনীকান্তের ‘আনন্দ নিকেতন’ পরিদর্শন করেন । বাড়িটি স্পর্শ করে শ্রদ্ধাভরে বলেছিলেন, ‘প্রাচীন যুগের স্বদেশি গানের স্রষ্টা, গীতিকার, সুরকার। আপনি আজও গানের মাঝে অমর হয়ে আছেন, আপনাকে নমস্কার।’
সম্প্রতি রাজশাহীতে ‘রজনীকান্ত সেন পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠেছে। সংগঠনের সদস্যসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, বাড়ির সামনে একটি নামফলক দেওয়া হোক। আর বাড়ির সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হোক তাঁরই নামে। মূল বাড়ির ছাদ ভেঙে টিনের ছাউনি করে দেওয়া আছে। যেটুকু আছে তা দিয়েই রাজশাহী শহর অনায়াসে দেশি-বিদেশি পর্যটক টানতে পারে। শুধু প্রয়োজন এটিকে রজনীকান্তের বাড়ি হিসেবে সংরক্ষণ করা।
শহরের মিয়াপাড়া এলাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কালজয়ী চলচ্চিত্রকার ও পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিও। বর্তমানে যেটা রাজশাহী হোমিও কলেজ, সেটিই ছিল ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি। ২০০৯ সালে রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটির আয়োজনে ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের ভাগনি (মেজ বোন সম্প্রীতি দেবীর মেয়ে) কানাডাপ্রবাসী রীনা চক্রবর্তী। দেশভাগের সময় এই বাড়ি ছেড়ে যান তিনি।
রীনা চক্রবর্তীর সঙ্গেই এই উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের বোন প্রতীতি দেবীর মেয়ে আরমা দত্ত। তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুর সময়টা কাটিয়েছেন রাজশাহী নগরের মিয়াপাড় এলাকায় অবস্থিত এই বাড়িতে। এ সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। এই বাড়িতে থেকেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী।
রীনা বলেন, বাড়ির সামনের সেই প্রাচীরের খানিকটা এখনো রয়েছে। ছোটবেলায় যাদের সঙ্গে ঝগড়া করতাম, ভাব করতাম, আড়ি দিতাম—সব ওই প্রাচীরের পাশে দাঁড়িয়েই। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ঘোষণার সময় তিনি এই বাড়িতে ছিলেন। এই প্রাচীরের পাশে অনেক মানুষ দাঁড়িয়েছিল। পাশেই ব্যানার্জি বাড়িতে একটি রেডিও ছিল। যেই রেডিওতে ঘোষণা হলো, রাজশাহী পাকিস্তান। সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষ লাফিয়ে উঠল। হাততালি দিতে লাগল। তিনিও তাঁদের সঙ্গেই হাততালি দিলেন। কিন্তু বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখেন সবার মুখ গোমড়া। এর তিন দিন পরই তাঁরা রাজশাহী ছেড়ে চলে যান। তিনিও স্মৃতি হিসেবে প্রাচীর থেকে একটি ইটের টুকরা তাঁর ব্যাগে ভরে নেন।
বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে ওই বছর হোমিও কলেজের মিলনায়তনটি ঋত্বিক ঘটকের নামে করার দাবি ওঠে। এ জন্য ২০০৯ সালে বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক একটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেটি ওইভাবেই রয়ে গেছে। বাড়ির পুরোনো অংশের দুই কক্ষের ভবনটির একটি কলেজের বহির্বিভাগ ও একটি গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, এটি এখন কলেজের সম্পত্তি। পুরোনো ঘরগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। একটি সংগঠনের আপত্তির কারণে তাঁরা এ কাজে হাত দিতে পারছেন না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি সাজ্জাদ বকুল বলেন, ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে হোমিও কলেজের নামে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা জানতে পেরেছেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ পরে তা অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠানের নামে খারিজ করে নিয়েছেন। ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণ করা দরকার।
বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস চর্চার পথিকৃৎ ও নাট্যকার অক্ষয়কুমার মৈত্রের বাড়ির জায়গাটিতে এখন নতুন স্থাপনা হয়েছে। নগরের ঘোড়ামারা এলাকায় ছিল তাঁর বাড়িটি। এটি এখন শুধুই স্মৃতি।
সুজন রাজশাহীর সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, রাজশাহী নগরকে যেভাবে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে, সেভাবে শহরের ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে শহরটির ঐতিহাসিক মূল্য রক্ষা পাবে। পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা বিকশিত হবে।