চিংড়ি ছেড়ে বোরো চাষ

কয়রা অঞ্চলে বোরো ধান আবাদের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা ছাড়িয়ে গেছে। ফলনও ভালো হয়েছে।

খেতের মধ্যেই মাড়াই করা হচ্ছে ধান। গত রোববার খুলনার কয়রা উপজেলার গাতিরঘেরি বিলেছবি: প্রথম আলো

খুলনার কয়রা উপজেলার গাতিরঘেরি গ্রামের কৃষক সাধন সরকার বোরো ধানের খেত পরিচর্যা করছিলেন। চোখে-মুখে তাঁর আনন্দের ঝিলিক। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ২৪ বছর পর বিলে লোনাপানির চিংড়ি ঘের বন্ধ করায় ধানের মুখ দেখছি। নিজের খেতে ধান দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। এই বিলের জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করায় কোনো ফসলের মুখ চোখে দেখা যেত না। চিংড়িতে রোগবালাইসহ ঘনঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ঘেরের কার্যক্রম বন্ধ না করা হলে এমন ধানের মুখ চোখে দেখতাম না।’ 

শুধু গাতিরঘেরি এলাকা নয়, গত রোববার ও সোমবার উপজেলার বাগালী, আমাদী, মহারাজপুর, উত্তর বেদকাশীসহ কয়েকটি এলাকার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, তীব্র তাপপ্রবাহ উপেক্ষা করে কৃষকেরা উৎসাহ নিয়ে ধান কাটার উৎসবে মেতেছেন। আবার অনেকেই ধান কাটা শেষে মাড়াই করছেন। যেসব জমির ধান এখনো কাটা হয়নি, সেসব জমি এখন সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে। ভালো ফলন পাওয়ায় কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক। কৃষি কার্যালয় জানিয়েছে, কয়রা অঞ্চলে বোরো ধান আবাদের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা ছাড়িয়ে গেছে। এবার ফলনও বেশ ভালোই হয়েছে।

কৃষকেরা বলেন, গাতিরঘেরির বিলে প্রায় ৭০০ কৃষকের জমি থাকলেও সেসব জমি ইজারা নিয়ে চিংড়ির ঘের করতেন ৫০ জন। প্রায় দেড় হাজার বিঘা জমিতে ২০০০ সাল থেকে লোনাপানি তুলে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। সারা বছর লোনাপানিতে ভরা থাকত বিল। পাশের জমিতে লোনাপানি থাকায় ছোট জমির মালিকেরা বাধ্য হয়ে তাঁদের জমিতেও ধানের বদলে চিংড়ি চাষ শুরু করেন। ধীরে ধীরে জমির লবণাক্ততা বসতভিটাতেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ফলে সেখানে শাকসবজিও লাগাতে পারতেন না কেউ।

আরেক কৃষক দেবাশীষ মণ্ডল বলেন, ‘চিংড়ি চাষে এখন আগের মতো লাভ হয় না। প্রতিবছর দুইবার মরে ভাইরাসে। উৎপাদনও ভালো নয়। সেই সঙ্গে দামেরও হেরফের রয়েছে। আবার চিংড়ির ঘেরে নদীর পানি প্রবেশের কারণে বেড়িবাঁধ ভাঙে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান আর ইয়াশের বেশ ভোগান্তি হয়েছে।  সব দিক বিবেচনায় ভেবেচিন্তে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম ধান চাষের। অনেক দিন পর জমির ধান লাগিয়ে এখন ধান কাটতে পেরে ভালো লাগছে।’

চিংড়ি চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া গাতিরঘেরি গ্রামের কৃষক নির্মল মণ্ডল, দিপক সরকার, দিলিপ কুমারসহ বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, বিলে তাঁদের জমি থাকার পরও সংসারে চালের চাহিদা মিটত না। বাড়িতে তরিতরকারিও লাগাতে পারতেন না। সবকিছুই বাজার থেকে কিনতে হতো। এবার লোনাপানি বন্ধ করে জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের বোরো আবাদে ফলন ভালো হওয়ায় সবাই খুশি।

কয়রা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় জানিয়েছে, উপজেলায় মোট ফসলি জমি ১৭ হাজার ২৭৪ হেক্টর। গত বছর বোরো আবাদ হয়েছিল ৪ হাজার ৯২৫ হেক্টরে। এবারও বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ৯২৫ হেক্টর জমিতে। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বোরো আবাদ হয়েছে ৫ হাজার ৭২৫ হেক্টরে। 

মহারাজপুর গ্রামের কৃষক আনিসুল হক বলেন, ‘আমার ১ একর জমিতে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে বোরো ধান চাষ করে ১০০ মণ ধান পেয়েছি। খরচ বাদে প্রায় ৮০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। আমাদের এলাকায় প্রায় ২০০ কৃষক বোরো ধানের আবাদ করেছেন। এসব জমি লবণাক্ততার কারণে বছরের ৭-৮ মাস পতিত থাকত। এখন থেকে প্রতিবছর আমরা আরও জমিতে বোরো ধানের চাষ করব।’

কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, এলাকায় লবণাক্ততার কারণে কৃষি উৎপাদন নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তবে স্থানীয় কৃষক ও জমির মালিকদের সঙ্গে নিয়ে তাঁরা চেষ্টা করেছেন, যাতে লোনাপানির প্রবেশ বন্ধ করা যায়। গাতিরঘেরি বিলে তাঁরা সেটা করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। লবণাক্ততার কারণে যেসব বিল এখনো অনাবাদি রয়েছে, সেসব বিলেও এ ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, কয়রা হচ্ছে তীব্র লবণাক্ত জলাভূমি এলাকা। এ এলাকার কৃষকেরা ধান চাষের চেয়ে চিংড়ি চাষে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কয়েক বছর ধরে বাগদা চিংড়িতে রোগবালাইসহ ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। তাই লোনাপানি উত্তোলন বন্ধ করে বাগদার পরিবর্তে কৃষি বিভাগ কৃষকদের লবণসহিষ্ণু জাতের ধান চাষে আগ্রহী করতে বীজ, সার ও কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তার কাজ শুরু করে।