উজানে পানি, চলনবিল খালি

বড়াল নদের উৎসমুখ। পদ্মা থেকে পানি ঢুকছে। এই পানি গিয়ে পড়ছে চলন বিলে। গত মঙ্গলবার দুপুরে রাজশাহীর চারঘাটেছবি: প্রথম আলো

চলনবিলের উৎসমুখের নদ-নদীগুলোয় পানি এসেছে। সেই পানি এখনো চলনবিলকে ভরিয়ে তুলতে পারেনি। প্রতিবছর এই সময় চলনবিলে পানি থই থই করে। সেই পানির সঙ্গে আসে প্রচুর মাছ। আসেন বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটক। এসব ঘিরে স্থানীয় লোকজনের আয়রোজগার বেড়ে যায়। স্থানীয় লোকজনের আক্ষেপ, আমন ধান বেড়ে ওঠার জন্য যে পানির দরকার, এখন পর্যন্ত সেই পরিমাণ পানিও চলনবিলে আসেনি। বলছেন, ভাটিতে যমুনা নদী না ভরলে চলনবিলে পানি ভরে না। উজান থেকে যেটুকু পানি আসে, সব যমুনায় নেমে যায়।

বড়াল, শিবনদ, বারনই, ছোট যমুনা, আত্রাই, নাগর, গুড়, বানগঙ্গা ও নন্দকুঁজা নদীর পানি চলনবিলে আসে। চলনবিলের ভেতরে সব নদীর পানি নিয়ে গুমানী একটি নতুন নদী নামে মূল বড়ালের সঙ্গে মিশে বড়াল নাম নিয়ে হুরাসাগার নদ নামে যমুনায় গিয়ে পড়েছে। এই নদ-নদীগুলোর উৎসমুখে পানি ঢুকেছে। এবার আষাঢ়ের প্রায় দিনই বৃষ্টি হয়েছে। মাসের শেষ দিনে মঙ্গলবার বড়াল নদের উৎসমুখ থেকে চলনবিল পর্যন্ত গিয়ে দেখা যায়, চলনবিলে কাঙ্ক্ষিত পানি এখনো ভরেনি।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রিফাত করিম বলেন, যেসব নদ-নদীর পানি চলনবিলে পড়ে, সেসব নদীর পানির উচ্চতা এখনো সেই পর্যায়ে আসেনি। পর্যটন এলাকাখ্যাত পাটুলের রাস্তাও এখনো ডোবেনি। এবার কেন দেরি হচ্ছে, নাকি হচ্ছে না, তা তিনি অতীতের রেকর্ড না দেখে বলতে পারবেন না। তিনি বলেন, আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো পানি চলে আসবে।

চলনবিলের ডাহিয়া গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে গেছে সড়ক। এখনো পানি আসেনি। দুই পাশে সবুজ খেত। মঙ্গলবার সন্ধ্যায়
ছবি: প্রথম আলো

বড়াল নদের উৎসমুখ রাজশাহীর চারঘাটের পদ্মা নদী। গত মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পানি ঢুকছে বড়ালে। স্রোতের বেগ খুব বেশি নয়। উৎসমুখের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিটকি জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন চারঘাট সদরের বাসিন্দা মাহমুদ আলম। পানির উচ্চতা তাঁর কোমরের চেয়ে একটু কম। তখনো তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। এই বড়ালের পানি নাটোরের নন্দকুঁজায় পড়েছে। আবার পাবনার ভেতর দিয়ে বড়ালের মূলধারা হুরাসাগরে গিয়ে পড়েছে। গুমানীও এসে বড়ালের মূলধারার সঙ্গে মিলেছে। নদ-নদীর পানি দেখতে দেখতে বিকেলের দিকে নাটোরের সিংড়ায় গিয়ে দেখা যায়, চলনবিলে সেই পানি নেই।

ইটালি ইউনিয়নের সাতপুকুরিয়া গ্রামের আশরাফুর রাব্বানী (৪৫) একটি নৌকা মেরামতের কাজ দেখছিলেন। বললেন, যমুনার সঙ্গে খালের মাধ্যমে চলনবিল সংযুক্ত। যত দিন পর্যন্ত যমুনা ভরে না, তত দিন পর্যন্ত চলনবিলে পানি জমে না। এবার আষাঢ়ে প্রতিদিন বৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু ভারী বৃষ্টি হয়নি। যে কারণে এখনো পানি আসেনি। গত বছর এ সময় পানিতে বিল ভরে গিয়েছিল। গ্রামের মাহবুব প্রামাণিক নিজের নৌকা মেরামত করছিলেন। তিনি বললেন, এখনো নৌকা নামানোর মতো পানি আসেনি, সে জন্য নৌকা দেরিতে মেরামত করছেন।

একই ইউনিয়নের বিলতাজপুর গ্রামের একটি রাস্তা বিলের বুক চিরে চলে গেছে। বটতলায় দাঁড়িয়ে তাজপুর গ্রামটি ছবির মতো দেখাচ্ছিল। এক পাশে আমন ধানের খেত, আরেক পাশ খালি পড়ে রয়েছে। রাস্তা নির্মাণ করার সময় এক পাশের মাটি তোলার কারণে নালার মতো হয়ে আছে। তাতেই সামান্য পানি জমেছে। সেই পানিতেই গোটা তিনেক নৌকা ভাসিয়েছেন তাজপুরের বাসিন্দারা। স্কুল থেকে ফেরার সময় ছোট বাচ্চাদের কেউ কেউ হাঁটার হাত থেকে বাঁচার জন্য নৌকায় চড়ছেন। সাধারণ বর্ষায় এই রাস্তা ডুবে যায়, তখন নৌকার ব্যবহার শুরু হয়। এবার সেই পানি না পেয়ে নৌকাওয়ালাদের যত আক্ষেপ।

সেখানেই দাঁড়িয়ে কথা হয় গ্রামের বাসিন্দা মো. শুভর সঙ্গে। বিলে এখন পানি কেন দরকার, পানি আসতে কেন দেরি হচ্ছে, না এলে কী সমস্যা হচ্ছে—বিস্তারিত বললেন তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘আমাগের এই দিক পানির খুবই দরকার। মানে বইন্যার সুমায় যদি বইন্যা না হয়, খারাপ লাগে আমাগের। বুঝতে পারিসেন? এই পানির আমাগেরে ধরেন এই যে এই বিলের দ্যাশেত এই চলনবিলেত আমাগেরে যে গরিব মানুষ সোবাই যার যার কর্ম লিয়ে তাই তাই মুনে করেন যে কর্ম কইরে খাবি, চলবি। বুঝতে পারিসেন? তাই আমাগেরে এই দিক পানির দরকার এখন।’

অতীতের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমুন ধাইনডা লাগানু। তো এই সমায় যদি পানিডা না হয় তো আমাগোরে ইনকাম হবি না। আবার ধানও তো দ্যাশেত ভালো হবি না। বুইজতারিসেন? এই কারণেই কচ্চি, পানির দরকার এখন। ইয়ার আগে ধরেন যে হালকা বিষ্টি হলে পারে যে পানিডা সেভাবে বইন্যা হইয়া যাচ্চিল। কিন্তু এইব্যার সে হিসেবে তো পানি কম।’

সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্রামের যুবক নাজমুল হক। তিনি বললেন, পানি এলে ধানের আবাদ হয়। পানি না এলে ধান হবে না আর মাছও হবে না।

নৌকা মেরামত করছেন মাহবুব প্রামানিক। নাটোরের সিংড়া উপজেলার সাত পুকুরিয়া গ্রামে মঙ্গলবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

কথা শেষ করে ফেরার সময় বকুল নামের মাঝবয়সী এক লোক পিছু নিলেন। তাঁর ভাষায়, তাঁরা অবস্থাসম্পন্ন মানুষ। জায়গাজমি আছে, আবাদ আছে। এরপরও বর্ষার সময় তাঁদের একটা বাড়তি রোজগার থাকে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসেন। নৌকায় করে তাঁরা ঘোরান।

ফেরার সময় ডাহিয়া মাঠের মধ্যে দাঁড়াতে হলো। গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। দুই পাশে আমনের খেত। চোখজুড়ানো দৃশ্য। রাস্তা দিয়ে ভটভটি, ভ্যান, অটোরিকশাই মূলত চলছে। এখানে দাঁড়িয়ে কবি ওয়ালী কিরণের কবিতা ‘ডাহিয়া’ মনে পড়ল। ‘এই জলসুন্দরী/ ডাহিয়া তাহার নাম/ পূর্বজন্মের মাতা/ চিরজীবী চিরযৌবনা/ তারে আজ প্রগাঢ় প্রণাম...।’

রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে দেখে মোটরসাইকেল থেকে নামলেন চলনবিল এলাকার যুবক পি এম আলমগীর। চলনবিল নিয়ে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বললেন, ‘এখন আপনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন, আমি ছোটবেলায় ১০–১২ ফিট পর্যন্ত পানি দেখেছি। কী ঢেউ।’ তাঁর ক্ষোভ, চলনবিলের ভেতর দিয়ে কৃষকের আবাদের জন্য নালা খনন করা হয়েছে। এই নালা দিয়ে যেটুকু বৃষ্টির পানি জমছে, সব নদীতে নেমে যাচ্ছে। এতে চলনবিলের ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে।