দালালের দৌরাত্ম্যে নাকাল

এই হাসপাতালে ২৪ জন দালাল কাজ করছেন। তাঁরা রোগীদের নানাভাবে হয়রানি করছেন।

মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে দালালদের আনাগোনা। গত বুধবার বেলা ১১টায়
ছবি: প্রথম আলো

মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। এতে সাধারণ রোগীদের বাইরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা করাতে গিয়ে অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে। এ ছাড়া দালালদের কারণে রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হাসপাতালের কর্মকর্তা, স্থানীয় বেসরকারি ক্লিনিক ও রোগনির্ণয়কেন্দ্রের (ডায়াগনস্টিক সেন্টার) মালিকেরা এই দালাল চক্র গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত বুধবার বেলা ১১টায় সরেজমিনে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের সমানে একদল তরুণ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম উজ্জ্বল। হাসপাতাল এলাকায় তাঁর বাড়ি। জরুরি বিভাগের চারদিকে সারিবদ্ধ ইজিবাইক দাঁড়ানো। ইজিবাইকের সামনে চালক দাঁড়িয়ে। এ সময় হাসপাতাল থেকে বের হন এক রোগী। হাতে তাঁর একটি ব্যবস্থাপত্র। তিনি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দালালেরা রোগী ও তাঁর স্বজনদের নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা–নীরিক্ষা করানোর জন্য টানাটানি শুরু করেন।

নাম গোপন রাখার শর্তে এক দালাল প্রথম আলোকে বলেন, জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মালিকেরা হাসপাতালে কর্মরত ঝাড়ুদার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ইজিবাইকচালকদের নিয়ে একটি দালাল চক্র তৈরি করেছে। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে পরীক্ষা–নিরীক্ষা লিখে দেওয়ার পর দালালেরা রোগীদের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের নিয়ে যায়। একজন রোগী নিয়ে আসতে পারলে একজন দালাল ১০০ টাকা পেয়ে থাকেন। একইভাবে সমপরিমাণ টাকা কমিশন পেয়ে থাকেন হাসপাতালের কর্মকর্তারা।

হাসপাতালের রোগনির্ণয়কেন্দ্রের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ইয়াসিন শেখ প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে এক্স–রে করাতে ২০০ টাকা, ইসিজি করাতে ৩০০ টাকা, রক্তের পরীক্ষা (সিবিসি) করাতে ৩৫০ টাকা খরচ হয়। অপর দিকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক্স–রে করাতে ৬০০ টাকা, ইসিজি করাতে লাগে ৭০০ টাকা, রক্তের পরীক্ষা (সিবিসি) পরীক্ষা বাবদ ১ হাজার ৭০০ টাকা খরচ করতে হয় বলে জানান সনো ল্যাবের কর্মকর্তা রাকিব হোসেন। অর্থাৎ জেনারেল হাসপাতালের পরিবর্তে বাইরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে গেলে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা বেশি খরচ হয়।

মেহেরপুর বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সভাপতি আবু তাহের বলেন, জেনারেল হাসপাতালে দালাল চক্র একটি বড় সমস্যা। দালালদের তৎপরতা বন্ধে হাসপাতালের ভেতরে স্থায়ীভাবে পুলিশ বা আনসার মোতায়েন করার সুপারিশ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।

হাসপাতালে দালাল চক্র সৃষ্টি করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেরপুর বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সভাপতি আবু তাহের বলেন, গুটিকয়েক অসাধু ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকের জন্য প্রতিটি বেসরকারি ক্লিনিকমালিককে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে। জেলা প্রশাসন কঠোর হলে তাদের সহযোগিতা করা হবে।

টানা এক সপ্তাহ হাসপাতাল এলাকা ঘুরে ২৪ জন সক্রিয় দালালের নাম পাওয়া গেছে। এঁরা হলেন মেহেরপুর পৌর শহরের রকিবুদ্দীন মিয়া, জামান আলী, উজ্জ্বল হোসেন ও সামসুল আলম, সামিম রহমান, সুমন মিয়া, জিয়ারুল হোসেন, আবদুল্লাহ আলী, সানোয়ার হোসেন, আবদুস শহীদ, মোনায়েম মিয়া, সেলিম রাজ, সজীব মিয়া, আলমগী মিয়া, লিয়াকত, আলম মিয়া, ফিরোজ আলী, কদর মিয়া, সেন্টু মিয়া, হাফিজুল ইসলাম, বরকত আলী, শাহনাজ পারভিন, সেফালি খাতুন ও জেসমিন আরা।

দালাল চক্রের হস্তক্ষেপে রোগীদের অনেক অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমন ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের একজন গাড়াবাড়িয়া গ্রামের মখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, তাঁর বাবা তাহাজদ্দি সরকার মাঠে কাজ করতে গিয়ে কোমরে আঘাত পান। পরে দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়। জরুরি বিভাগ থেকে প্রাথমিক ব্যবস্থাপত্র নিয়ে এক দালাল ভালো চিকিৎসার কথা বলে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে আট ধরনের পরীক্ষা করানোর পর ওষুধ লিখে দেওয়া হয়। চিকিৎসা করাতে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে।

জেনারেল হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক হাসিবুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, দফায় দফায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে দালালদের তৎপরতা বন্ধে বৈঠক হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয় না। হাসপাতালে সার্বক্ষণিক পুলিশ অথবা আনসার সদস্য মোতায়েন ও ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করে নিয়মিত তদারকি করা হলে দালালদের তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব হবে।