সাত খুন মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করার দাবি আইনজীবী ও স্বজনদের

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার দাবিতে নিহতদের স্বজন ও আইনজীবীদের মানববন্ধন।বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে ‘নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সাধারণ আইনজীবী’ এবং ‘নিহত সাতজনের পরিবারের সদস্যবৃন্দ’ ব্যানারে এ মানববন্ধন হয়।

আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ৯ বছর উপলক্ষে আয়োজিত মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সাত খুনের ঘটনায় করা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী শাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে কী নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা সারা দেশের মানুষ জানে। নূর হোসেন, র‌্যাব কর্মকর্তাসহ অন্য আসামিদের যদি দ্রুত শাস্তির আওতায় না আনা হয়, তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি সারা দেশের মানুষের অনাস্থা তৈরি হবে। আর বিচার হলে আইন ও আদালতের প্রতি মানুষ আস্থাশীল হবেন।

গুরুত্ব বিবেচনা করে দ্রুত মামলাটির আপিল শুনানি শুরুর দাবি জানিয়ে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আসামিরা জানে আপিল বিভাগেও তাদের শাস্তি বহাল থাকবে। এ কারণে তারা চাইছে আপিল শুনানি দেরি করে হোক। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ চাইলেই মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনায় দ্রুত আপিল শুনানি শুরু হতে পারে। সে জন্য রাষ্ট্রপক্ষের সদিচ্ছা প্রয়োজন।’

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় র‌্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের গাড়ি থামান। র‌্যাব নজরুল, তাঁর তিন সহযোগী ও গাড়িচালককে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। তিনি অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় তাঁকে ও তাঁর গাড়িচালককেও র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের সবাইকে হত্যা করে ওই রাতেই পেট কেটে এবং ইটের বস্তা বেঁধে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেয়। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল ছয়জন ও পরদিন একজনের লাশ ভেসে ওঠে।

হত্যার শিকার সাতজন হলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিম। ওই ঘটনায় দুটি মামলা হয়, একটির বাদী নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম এবং অপরটির বাদী আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল।

খুনিদের সাজার রায় কার্যকর করার দাবি জানানোর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী সামসুন নাহার। পাশে বাবার ছবি বুকে নিয়ে শিশু রওজা মণি। বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলি এলাকায়
ছবি: দিনার মাহমুদ

মানববন্ধনে বক্তব্য দেন মনিরুজ্জামানের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর হোসেনের স্ত্রী শামসুন্নাহার, নজরুল ইসলামের সহযোগী নিহত তাইজুল ইসলামের ভাই মো. রিপন, ন্যাপ নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি আইনজীবী আওলাদ হোসেন।

স্বামী হত্যার দ্রুত বিচার চেয়ে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী শামসুন্নাহার বলেন, ‘যখন আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়, তখন আমি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার গর্ভে থাকা সেই সন্তানের বয়স এখন ৯ বছর। আমার সন্তান বড় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এত বড় একটা হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হচ্ছে না।’

স্বামীহারা এই নারী জীবনের নানা সংগ্রামের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘স্বামী ছাড়া একজন নারীকে সংসার চালাতে কত কষ্ট করতে হয়, তা বোঝার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। সেই কষ্ট রাষ্ট্র না বুঝুক, কিন্তু স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার দেখতে না পারার যে কষ্ট, সেটা তো বোঝা উচিত। আমরা চাই দ্রুত এই মামলার আপিল নিষ্পত্তি করে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হোক।’

আলোচিত এ হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‍্যাব-১১ চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ, চাকরিচ্যুত মেজর আরিফ হোসেন, চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট উচ্চ আদালত ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৯ সালে র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন, এম মাসুদ রানা, সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা নূর হোসেনসহ দণ্ডিত আসামিরা পৃথক আপিল করেন।

নিহত তাইজুল ইসলামের ভাই রিপন মানববন্ধনে বলেন, মাত্র ৩৩ মাসে নিম্ন আদালত ও ১৯ মাসে হাইকোর্ট এই মামলার রায় ঘোষণা করেছেন। রায়ে খুনিদের ফাঁসি দিয়েছেন। কিন্তু সাড়ে চার বছরেও আপিল বিভাগে মামলার শুনানিও শুরু হলো না।