৪০০ বধ্যভূমি থেকে আনা মাটিতে শহীদ বাবাকে খোঁজেন মেয়ে

একাত্তরে শহীদ বাবার কবরের খোঁজে সেলিনা রশিদ সারা দেশের ৪০০ বধ্যভূমি থেকে মাটি সংগ্রহ করে নিজের বাড়িতে জাদুঘর করেছেনছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের ভালুকায় মহাসড়কের পাশে দৃষ্টিনন্দন একটি বাড়ি। বাড়িটির একটি অংশের দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির মুখে শিল্পীর আঁকা একটি ছবি। ছবিতে দেখা যায়, গ্রামের আলপথ ধরে একজন পুরুষ চলে যাচ্ছেন। তাঁর চলে যাওয়ার শোকে কাতর একটি মেয়েশিশু আলপথে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আরও দূরে একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন শোকাতুর এক নারী।

ছবিটি স্মৃতির বর্ণনা থেকে আঁকা। ছবির পুরুষ ব্যক্তিটির নাম জহির উদ্দিন। পথে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকা শিশুটি জহির উদ্দিনের মেয়ে সেলিনা রশিদ। আর নারীটি হচ্ছেন জহির উদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারা খাতুন। ছবিটির প্রেক্ষাপট ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের, আর স্থান গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার চকপাড়া গ্রাম। সেদিন জহির উদ্দিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।

ছবিটি একজন শিল্পীকে দিয়ে আঁকিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাবার চলে যাওয়ার দিনটিকেই উজ্জ্বল করে রাখতে চেয়েছেন মেয়ে সেলিনা রশিদ।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার পর আরও চমকে যেতে হয়। লম্বা একটি বারান্দার ধারে দুই পাশে দেয়ালের সঙ্গে সাঁটানো ছোট ছোট মাটির পাত্র। পাত্রগুলোতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার বধ্যভূমির নাম লেখা। জানতে চাইলে সেলিনা রশিদ বলেন, এখানে দেশের প্রায় ৪০০টি বধ্যভূমি থেকে মাটি এনে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কারণ, ১৯৭১ সালে বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার পর তাঁর বাবা জহির উদ্দিন আর কোনো দিন ফেরেননি। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হয়েছেন। তবে কোথায় তাঁর কবর হয়েছে, সেটি জানা যায়নি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাবার কবর খুঁজতে গিয়ে তিনি দেশের ৪০০ বধ্যভূমি থেকে মাটি সংগ্রহ করে নিজের বাড়িতে করেছেন অনন্য এ জাদুঘর।

২০১০ সাল থেকে সেলিনা রশিদ বাবার কবর খুঁজে বের করার লড়াই শুরু করেন
ছবি: প্রথম আলো

এখনো বাবার কবরের খোঁজে সেলিনা রশিদ সারা দেশে ঘুরে বেড়ান। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সমাজসেবা ও রাজনীতিতে যুক্ত। তিনি ময়মনসিংহ জেলা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক।

সম্প্রতি ভালুকায় সেলিনা রশিদের বাড়িতে গেলে তিনি বাবার স্মৃতি খোঁজা এবং ৪০০ বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহের গল্প শোনান। তিনি বলেন, তাঁর বাবা জহির উদ্দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের আভাস পাওয়ার পর তিনি চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। একাত্তরের এপ্রিল মাসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাড়ি ছাড়েন। তখন তাঁর বয়স ৮ কি ৯ বছর। যুদ্ধ শেষে বাবা আর ফেরেননি। স্বামী বেঁচে নেই, এটা শুরুতে বিশ্বাস করতে পারেননি তাঁর মা আনোয়ারা খাতুন। তখন তাঁদের চার বোনকে নিয়ে বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে বসে থাকতেন মা। ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত হলে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, ‘তোদের বাবা ট্রেন থেকে নামবে তোদের জন্য খাবার নিয়ে।’

একটা সময় বাস্তবতাকে মেনে নেন আনোয়ারা খাতুন। চার মেয়েকে বড় করেন। এর মধ্যে সেলিনার বিয়ে হয় ময়মনসিংহের ভালুকায়। সংসার আর সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যেই তিনি দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে গিয়ে বাবার মৃত্যু ও কবরের বিষয়ে খোঁজ নিতেন। একপর্যায়ে জানতে পারেন, ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট ৬ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করতে গিয়ে তাঁর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন মারা যান। ২০১০ সাল থেকে তিনি বাবার কবর খুঁজে বের করার লড়াই শুরু করেন। একে একে ছুটে যান দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে। সেখানে বাবার নামটি না পেয়ে হতাশ হন তিনি। তবে সেসব বধ্যভূমি থেকে মাটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। এভাবে প্রায় ৪০০ বধ্যভূমির মাটি তিনি সংগ্রহ করে জাদুঘর করেছেন নিজের বাড়িতে।

লম্বা বারান্দার ধারে দুই পাশে দেয়ালের সঙ্গে তাক করে রাখা ছোট ছোট মাটির পাত্র। পাত্রগুলোতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার বধ্যভূমির নাম লেখা
ছবি: প্রথম আলো

সেলিনা রশিদ বলেন, ‘বাবাকে খুঁজতে গিয়ে বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহ শুরু করি। প্রথমে কোথাও বাবার কবর না পাওয়ায় একটা আক্ষেপ কাজ করত। সে আক্ষেপ কমে গেছে। এখন মনে হয়, আমার ঘরে থাকা বধ্যভূমির মাটির কোথাও না কোথাও আমার বাবার স্মৃতিচিহ্ন আছে।’