বাঘারপাড়ায় কাজে আসছে না সরকারি ভুট্টামাড়াই যন্ত্র

পুরাতন ভবনের মধ্যে দুটি ভুট্টামাড়াই যন্ত্র পড়ে আছে। গত সোমবার যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দরাজহাট ইউনিয়ন পরিষদে
ছবি: প্রথম আলো

কৃষক মিরাজুল মোল্যা এবার জমিতে ভুট্টা চাষ করেননি। তবে আগামী মৌসুমে পাঁচ কাঠা জমিতে তিনি ভুট্টা চাষ করবেন বলে ভেবে রেখেছেন। তিনি জানতে পারেন, ইউনিয়ন পরিষদে দুটি ভুট্টামাড়াই যন্ত্র পড়ে আছে। সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান, মাড়াই যন্ত্র দুটির অবস্থা ভালো নয়। দুই মাস আগে সেখান থেকে তিনি একটি মাড়াই যন্ত্র এনে মেরামত করে বাড়িতে রেখেছিলেন। কিন্তু পরে মাড়াই যন্ত্রটি আবার নষ্ট হয়ে গেছে।

মিরাজুল ইসলামের বাড়ি যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বাসুয়াড়ী ইউনিয়নের পাকের আলী গ্রামে। মিরাজুল বলেন, ‘আমি ভুট্টা চাষ করিনি। তবে আগামী বছর পাঁচ কাঠা জমিতে ভুট্টা চাষ করার নিয়ত আছে। দুটি ভুট্টামাড়াই মেশিন ইউনিয়ন কাউন্সিলে পড়ে ছিল। একটি মেশিন দুই মাস বাড়িতে এনে রেখেছি। মাড়াই করব বলে কিছু টাকা খরচ করে মেশিনটি মেরামত করেছিলাম। কিন্তু আবার তা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মেরামত করতে গেলে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগবে। মেশিনটি ওই অবস্থায় পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছি।’

একই ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম গত বছর এক বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছিলেন। স্থানীয়ভাবে তিনি ওই ভুট্টা মাড়াই করেছিলেন। এ বছর তিনি কোনো ভুট্টার চাষ করেননি। কিন্তু কয়েক মাস আগে তিনি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি ভুট্টামাড়াই যন্ত্র বাড়িতে এনে রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এবার গমের চাষ করেছি। ভেবেছিলাম, মেশিনটি দিয়ে গম মাড়াই করব। ১ হাজার ৭০০ টাকা খরচ করে মেশিনটি মেরামত করেছি। কিন্তু মেশিনটি পুনরায় নষ্ট হয়ে গেছে।’

কৃষকদের উৎপাদিত ভুট্টা সহজ পদ্ধতিতে এবং বিনা মূল্যে মাড়াইয়ের জন্য দুই বছর আগে বাঘারপাড়া উপজেলায় সরকারি টাকায় কেনা হয়েছিল ১২টি মাড়াই যন্ত্র। কিন্তু বেশির ভাগ প্রকৃত ভুট্টাচাষিরা সরকারি ভুট্টামাড়াই যন্ত্রের বিষয়ে জানেনই না। ফলে ভুট্টামাড়াই যন্ত্রগুলো ভুট্টাচাষিদের তেমন কোনো কাজে আসছে না। দীর্ঘদিন পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে বেশির ভাগ মাড়াই যন্ত্র।

বাঘারপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বলেন, ভুট্টা চাষের মূল সমস্যা মাড়াই করা। মাড়াই যন্ত্রগুলো কেনার ফলে উপজেলায় ভুট্টা চাষ বেড়েছে। মাড়াই যন্ত্রগুলো ইউনিয়ন পরিষদে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মাঠ দিবস ও কৃষক সমাবেশগুলোয় ভুট্টাচাষিদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মাড়াই যন্ত্র নিয়ে ভুট্টা মাড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করি। এবার অনেক কৃষক মাড়াই যন্ত্র নিয়ে ভুট্টা মাড়াই করছেন।’

উপজেলার ধলগ্রাম ইউনিয়নের আগড়া গ্রামের কৃষক আবদুল মজিদ এবার দুই বিঘা (৫২ শতকে বিঘা) জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। আর কয়েক দিন পর তিনি খেত থেকে ভুট্টা তুলবেন। মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর আগে একবার আমি ভুট্টার চাষ করেছিলাম। সেবার প্রতি বিঘা ১ হাজার ২০০ টাকায় ভুট্টা মাড়াই করেছিলাম। ভাড়া ছাড়াই সরকারি মেশিনে ভুট্টা মাড়াই করা যায়, আপনার কাছে শুনলাম। এটা হলে তো খুব ভালো হয়। মেশিনের ব্যাপারে ইউনিয়ন কাউন্সিলে গিয়ে খোঁজ নেব।’

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলায় নয়টি ইউনিয়ন। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে দুটি করে মোট ১২টি ভুট্টামাড়াই যন্ত্র কেনা হয়। এর মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নে স্থানীয় সরকার সহায়তার প্রকল্পের (এলজিএসপি-৩) আওতায় প্রতি দুটি মাড়াই যন্ত্র ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা করে মোট ১০টি যন্ত্র ১১ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় এবং একটি ইউনিয়নে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় দুটি মাড়াই যন্ত্র ২ লাখ ৬০ হাজার টাকায় কেনা হয়। মাড়াই যন্ত্রগুলো ইউনিয়ন পরিষদে এনে রাখা হয়। কেনার পর থেকে বেশির ভাগ মাড়াই যন্ত্র সেভাবেই পড়ে আছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি মাড়াই যন্ত্রের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে।

বাসুয়াড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান সরদার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্র দুটি ইউনিয়ন পরিষদে পড়ে ছিল। একটি যন্ত্রের চাকার টায়ার নষ্ট হয়ে গেছে। দুজন কৃষক যন্ত্র দুটি নিয়ে গেছেন। তাঁদের কাছ থেকে কোনো ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না।বাঘারপাড়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ভুট্টা লাভজনক ফসল। ভুট্টা চাষে খরচ কম। লাভ বেশি। তবে ভুট্টা চাষের একটাই সমস্যা—মাড়াই করা। উপজেলায় এবার ৩৮ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে।

বন্দবিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সবদুল হোসেন খান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে অনেক জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। আমার দুটি ভুট্টামাড়াই মেশিন ভুট্টাচাষিরা বিনা মূল্যে নিয়ে ভুট্টা মাড়াই করছেন। দুটি মেশিনই ভালো আছে।’

গত সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, দরাজহাট ইউনিয়ন পরিষদের পুরাতন ভবনের মধ্যে দুটি মাড়াই যন্ত্র পড়ে আছে। আর ধলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে পলিথিন দিয়ে ঢাকা রয়েছে দুটি মাড়াই যন্ত্র। বাসুয়াড়ী ইউনিয়ন পরিষদের দুটি মাড়াই যন্ত্র রয়েছে।
দরাজহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, গত বছর ইউনিয়নে ভুট্টা চাষ হয়নি। এ জন্য ভুট্টামাড়াই যন্ত্র দুটি পড়ে ছিল। এবার ভুট্টার চাষ হয়েছে। গত মঙ্গলবার একজন কৃষক ভুট্টা মাড়াইয়ের জন্য একটি যন্ত্র নিয়ে গেছেন।

ধলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম বলেন, ভুট্টামাড়াই যন্ত্র দুটি কাজে আসছে না। কৃষক ভুট্টা মাড়াই করতে যন্ত্র দুটি নিচ্ছেন না। যন্ত্র দুটি ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা আছে। সম্প্রতি ঝড়ে পলিথিন ছিঁড়ে উড়ে গেছে। দ্রুত মাড়াই যন্ত্র দুটি সরিয়ে ভালো জায়গায় রাখা হবে।