শেষবার জুলফিকারের মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলেছিলেন, ‘নাগো বাজান, আস্থা আছে’
৪ আগস্ট রাজধানী ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগ দিতে মিরপুরের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন জুলফিকার আহমেদ। ভাত খেতে দুপুরে বাসায় ফিরেছিলেন। তখন মা বিবি আয়েশাকে জুলফিকার জানান, তাঁদের জন্য সাততলার ওপর একটি ভালো বাসা দেখে রেখেছেন। আগস্ট মাসেই সেখানে উঠবেন।
মা তখন বলেছেন, তাঁর কোমরে ব্যথা, সাততলার ওপর ওঠা কষ্টের হবে। তিনি যেন ওই বাসা বাদ দিয়ে নিচতলায় একটি বাসা দেখেন। এ জন্য মা বারবার তাগাদাও দেন। তখন জুলফিকার বলেছিলন, ‘আসলে মা, তোমাগো আমার ওপর আস্থা কম।’ আয়েশা তখন জুলফিকারের মাথায় শেষবার হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘নাগো বাজান, আস্থা আছে! আস্থা আছে!’
ভোলা সদর উপজেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের নয়ারচর গ্রামে বসে শুক্রবার ছেলেকে নিয়ে এই স্মৃতিচারণা করছিলেন বিবি আয়েশা। তাঁর ছেলে জুলফিকার ৪ আগস্ট মিরপুর-১০–এ গুলিতে আহত হয়ে ঢাকার আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। গত বুধবার বিকেলে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
জুলফিকার ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডা) চারুকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ঢাকা মহানগর ছাত্র ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তাঁর বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নে। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ভেলুমিয়া ইউনিয়নের মধ্য বাঘমারা গ্রামে জুলফিকারের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে ভোলা সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ও মসজিদ প্রাঙ্গণে দুটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জুলফিকার আহমেদের মা বিবি আয়েশা (৫৩) এখন আছেন মধ্য বাঘমারা গ্রামের পাশেই নয়ারচর গ্রামে ভাইয়ের বাড়িতে। সেখানে শুক্রবার দুপুরে মিলাদের তবারক রান্নার কাজ চলছিল। সেগুলো দেখাশোনা করছিলেন বিবি আয়েশা।
সেখানে জুলফিকারের মা, খালা রেহানা বেগম, মামা শহীদুল ইসলামসহ একাধিক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জুলফিকারের পরিবারের বর্তমানে আশ্রয় নেওয়ার মতো কোথাও একখণ্ড জমি নেই। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে। বাবা মরহুম সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন জেলে। ২০০০ সালের দিকে মেঘনার ভাঙনে বাড়ি বিলীন হলে ২ মেয়ে ও ২ ছেলেকে নিয়ে ভেলুমিয়া ইউনিয়নের বাঘমারা গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নেন সিদ্দিকুর। এর মধ্যে তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৩ সালে মারা যান। এর মধ্যে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান আয়েশা।
আয়েশা বিবি বলেন, সেদিন ভাত খেয়ে বের হয়ে যাওয়ার এক-দেড় ঘণ্টা পর মুঠোফোনে খবর আসে, জুলফিকারের মাথায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ গুলি করেছে। তাদের ছোড়া দুটি গুলি মাথায় ঢুকেছে। তাঁকে ঢাকার আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে চিকিৎসক জানিয়েছেন, অভিভাবক ছাড়া রোগী ভর্তি করাবে না, তাই মাকে যেতে হবে। তিনি যাওয়ার পর জুলফিকারের লাগা দুটি গুলির একটি বের করা সম্ভব হয়। আরেকটি এখনো মাথায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট বিকেলে জুলফিকার মারা যান।
জুলফিকার মিরপুর-১০–এ প্রথমে ব্র্যাক স্কুলে পড়াশোনা করেন। পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর একটি বেসরকারি সংস্থা তাঁর পড়ার খরচের দায়িত্ব নেয়। এরপর পাঠশালা নামক বিদ্যালয় থেকে অষ্টম, ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিদ্যালয় থেকে ২০২০ সালে এসএসসি ও হারুন মোল্লা ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০২২ সালে এইচএসসি পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে।
জুলফিকারকে কখনো পড়ালেখার খরচ দিতে হয়নি উল্লেখ করে বিবি আয়েশা বলেন, বরং উল্টো মাসে মাসে ঘরভাড়ার টাকাসহ মায়ের ওষুধের খরচ দিতেন জুলফিকার। ছোট ভাইটাকে পড়ার জন্য বই কিনে দিতেন। বলতেন বাড়িতে বসে পড়তে। এসএসসি পরীক্ষা দিতে। কিন্তু ছোট ভাইটি পড়েনি।
নানা কারণেই মায়ের খুব আদরের সন্তান ছিলেন জুলফিকার আহমেদ। সেই কথা উল্লেখ করে বিবি আয়েশা বলেন, ‘দুটি মেয়ের অনেক পরে জুলফিকার কোলে আসে। এত আদরের ছেলেকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে মারল। কী ছিল তার অন্যায়! আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই!’