সেন্টুকে হারিয়ে এখন দিশাহারা পরিবারটি

নৌকাডুবির ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে বিপদে পড়েছে ১৭টি পরিবার।

ফাইল ছবি

এক বছরের মেয়ে জ্যোতি রানীকে কোলে নিয়ে ঘরের বারান্দায় বসে কাঁদছিলেন ভৈরবী রানী (২১)। পাশে বসে ছিলেন ভৈরবীর শাশুড়ি পার্বতী রানী (৫০)। নৌকাডুবির ঘটনায় মারা গেছে ভৈরবীর স্বামী সেন্টু বর্মন (২৮)। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা এই পরিবারটি।

গতকাল শনিবার বিকেলে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের বটতলী এলাকার সেন্টুর বাড়িতে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। শুধু সেন্টুর পরিবার নয় গত রোববারের নৌকাডুবির ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে এমন বিপদে পড়েছে ১৭টি পরিবার। প্রিয়জন হারানোর শোক কাটতে না কাটতেই সন্তানদের ভবিষ্যৎ আর সংসারের চালানোর কথা ভাবতে হচ্ছে তাঁদের।

সেন্টু বর্মনের মা পার্বতী রানী (৫০) বলেন, তাঁরা আগে মানুষের জমিতে ঘর বেঁধে থাকতেন। তাঁর স্বামী মারা গেছেন ১৮ বছর আগে। তখন থেকে এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। পরে ছেলে সেন্টু বড় হলে মা-ছেলে দুজনে কাজ করে বাড়ি ভিটার ১৬ শতক জমি কিনে ঘর বেঁধেছেন। দুই বছর আগে ছেলে সেন্টুকে বিয়ে দেন। তাঁর বয়স হওয়ায় সেন্টুই দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন সেন্টু নেই। তাঁদের সব শেষ হয়ে গেল। ছোট্ট মেয়েটাকে কীভাবে বড় করবেন, জানেন না।

বটতলী এলাকার দিনমজুর জগদীশ চন্দ্র বর্মনও (৩৫) ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সাত বছরের একটি ছেলে আর দেড় বছরের একটি মেয়ে রয়েছে জগদীশের। জগদীশকে হারিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন তাঁর বৃদ্ধ মা আর স্ত্রী ফুলমতি রানী।

সাকোয়া ইউনিয়নের শিংপাড়া এলাকার ইটভাটা শ্রমিক প্রদীপ কুমার বর্মনও (৩২) ছিল ৬ সদস্যের পরিবারের একমাত্র আশা। প্রদীপের বাবা মনিরাম বর্মন (৬০) বলেন, ‘আমার বয়স হয়ে যাওয়ায় ছেলেটাই ইটভাটায় কাজ করে সংসারটা চালত। ওর ছেলে দুইটাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। কীভাবে ওদের মানুষ করব, কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না।’

নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার পামুলী এলাকার হরিকেশর বর্মণ (৩০) বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। তিনিও ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়ে, স্ত্রী এবং বাবা-মাকে নিয়ে ছিল সংসার। একটি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির চাকরি করে সংসার চালাতেন তিনি। হরিকেশরের শ্যালক চিত্তরঞ্জন বর্মন বলেন, হরিকেশরের পুরো পরিবারটা অন্ধকারের মধ্যে পড়ে গেল। সরকার যদি তাঁর বোনটাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে হয়তো পরিবারটা বাঁচবে।

গত রোববার দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার করতোয়া নদীতে শতাধিক মানুষ নিয়ে ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা ডুবে যায়। যাত্রীরা সবাই মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন। ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো এক শিশুসহ তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন। এদিকে সর্বশেষ গত বুধবার বিকেলে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের পর থেকে আর কোনো লাশ উদ্ধার করা হয়নি। এ ছাড়া শনিবার সপ্তম দিনে সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে নিখোঁজ তিনজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে নিখোঁজদের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, নৌকাডুবির ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে যে পরিবারগুলো একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়েছেন ইতিমধ্যে তাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁরা ওই পরিবারগুলোর জন্য আলাদা করে কিছু করার চিন্তাভাবনা করছেন।