এমন তীব্র তাপপ্রবাহ যাঁদের সুদিন এনেছে
তীব্র তাপপ্রবাহে আক্রান্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চল। আবহাওয়া বিভাগের হিসাবে তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হয়েছে। এমন তাপপ্রবাহে জনজীবন অনেকটাই স্থবির। সবাই যখন বৃষ্টির অপেক্ষায় দিন গুনছেন, তখন কক্সবাজার অঞ্চলের লবণচাষিরা এমন আবহাওয়াকে মনে করছেন আশীর্বাদ।
তাপপ্রবাহ সুদিন এনেছে কক্সবাজারের লবণচাষিদের জন্য। তাপপ্রবাহ বেশ কয়েক দিন অব্যাহত থাকায় এই অঞ্চলে লবণের উৎপাদন বেড়ে গেছে। এমন আবহাওয়ায় দৈনিক ২৬ হাজার মেট্রিক টন করে লবণ উৎপাদন হচ্ছে কক্সবাজার জেলায়। বেড়েছে লবণের দামও। সব মিলিয়ে খুশি লবণচাষিরা। বৃষ্টি যত দিন না হয়, তত দিন লবণের এমন বাড়তি উৎপাদন হবে সেখানে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ এ বি হান্নান বলেন, গতকাল শনিবার কক্সবাজারে তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আপেক্ষিক আর্দ্রতা ছিল ৫৮ শতাংশ। আজ রোববারও তীব্র তাপপ্রবাহ বিরাজ করছে। আর এ কারণে মাঠগুলোতে খুব দ্রুত উৎপন্ন হচ্ছে লবণ।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। গত ১৭ এপ্রিল বৃষ্টিসহ ঝোড়ো বাতাসে লবণ উৎপাদন ৭ দিন বন্ধ ছিল। এরপর আবার শুরু হয়। গতকাল শনিবার এক দিনে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ২৬ হাজার মেট্রিক টন। আজ রোববার উৎপাদন আরও ১ মেট্রিক টন বেড়ে ২৭ হাজার মেট্রিক টন হতে পারে। গতকাল পর্যন্ত মৌসুমের পাঁচ মাসে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ২০ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
বেড়েছে লবণের দামও। দুই সপ্তাহ আগে প্রতি মণ লবণ ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ২৮০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও প্রতি মণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে চাষিদের খরচ হচ্ছে ২৮০ টাকার বেশি।
তাপপ্রবাহে খুশি ৪০ হাজার চাষি
কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলায় প্রায় ৭ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। চাষির সংখ্যা ৪ হাজারের মতো। আজ সকালে উপজেলার উত্তর ধুরুং, লেমশিখালী, আলী আকবরডেইল, বড়ঘোপ ও দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়ন ঘুরে লবণের মাঠগুলোতে চাষিদের ব্যস্ততা দেখা গেল। বাড়তি উৎপাদন হওয়ায় মাঠ থেকে লবণ সংগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা।
উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের কৈলার পাড়ার চাষি আবদুল্লাহ মামুন (৪৫) জানান, তিন দিন ধরে খুব গরম পড়ছে। প্রখর রোদে লবণ উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি গুণমানও ভালো হচ্ছে। এ কারণে লবণের দামও বেড়েছে। সাত-আট দিন আগেও প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকায়। তবে গত দুদিন ধরে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাতে চাষিরা খুশি।
কক্সবাজার সদরের খুরুলকুল, চৌফলদন্ডী, ভারুয়াখালী, পিএমখালীসহ পেকুয়া, চকরিয়া, মহেশখালী, ঈদগাঁও ও টেকনাফ উপজেলাতেও লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়োছে।
মহেশখালী লবণচাষি ও কক্সবাজার লবণমিল মালিক সমিতির সদস্য হাসানুল আবেদীন বলেন, বৃষ্টির কারণে সাত দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকায় দেশব্যাপী লবণের চাহিদা বেড়েছে, এ কারণে মাঠপর্যায়ে লবণের দাম বেড়ে ২৮০-৩০০ টাকায় উঠেছে। চাষিরা এখন ভালো দাম পাচ্ছেন। তবে উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দাম কমে যাওয়ারও নজির রয়েছে।
তবুও ঘাটতি
মহেশখালী লবণচাষি ঐক্য সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শাহাব উদ্দিন বলেন, লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে মৌসুমের শুরু থেকে বহু চাষি হতাশ ছিলেন। লোকসানের কারণে অনেকে উৎপাদন বন্ধ রেখেছিলেন। তবে এখন লবণের ভালো দাম পাচ্ছেন।
বিসিকের দেওয়া তথ্যমতে, দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন; কিন্তু গতকাল শনিবার পর্যন্ত চলতি মৌসুমের পাঁচ মাসে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ২০ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। সে হিসাবে লবণের ঘাটতি থাকে ৫ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। মৌসুম শেষ হতে সময় আছে মাত্র তিন-চার দিন।
এ প্রসঙ্গে বিসিকের লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, এখন দৈনিক ২৬ হাজার মেট্রিক টন করে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। তাপপ্রবাহ আরও চার দিন বিরাজ করলে ২ লাখ মেট্রিক টন লবণ পাওয়া যাবে। তখন ঘাটতির পরিমাণ আরও কমে আসবে।
লবণ কিনবে সরকার
মাঠপর্যায়ের লবণের দাম এবং চাষপদ্ধতি সরেজমিন দেখতে শনিবার দুপুরে কক্সবাজার সদরের চৌফলদণ্ডী, ভারুয়াখালী এলাকা পরিদর্শন করেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ওবায়দুর রহমান। আজ দুপুরে তিনি জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে লবণচাষি, লবণ মিল মালিক, বিসিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে লবণচাষিদের ডেটাবেজ করে নীতিমালা তৈরির আশ্বাস দিয়ে শিল্পসচিব বলেন, লবণশিল্পের উন্নয়নে সরকার খুবই আন্তরিক। দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে লবণমাঠের বর্গা মূল্য নির্ধারণ, চাষিদের প্রণোদনা, স্বাস্থ্যসেবা ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। চাষিদের জন্য চৌফলদণ্ডীতে লবণ গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। সরকার সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে লবণ কিনবে, যা বিভিন্ন গুদামে সংরক্ষণ করা হবে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের পটিয়ায় গোডাউন করা হচ্ছে। সেখানে এক লাখ টন লবণ সংরক্ষণ করা যাবে। তাতে ঢাকাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে।