লুট হয়ে যাচ্ছে সোমেশ্বরী নদী

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ে জন্ম সোমেশ্বরীর। নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সোমেশ্বরী এখন আর নদী নেই, হয়ে গেছে ক্ষীণ এক জলধারা। শত শত অবৈধ ‘বাংলা ড্রেজার’ দিয়ে প্রতিদিন বালু তোলায় নদীটি এখন সংকুচিত ও ক্ষতবিক্ষত।

অবৈধ বাংলা ড্রেজার দিয়ে বালু তোলায় ক্ষতবিক্ষত সোমেশ্বরী নদীর বুক। গত বুধবার নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলায়ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

লুট হয়ে যাচ্ছে সোমেশ্বরী নদী। এতকাল দখল, দূষণ—এসব শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল নানা নদীর নাম। কিন্তু পাহাড়ি খরস্রোতা সোমেশ্বরীর দশা দেখে মনে হলো শুধু দখল–দূষণ নয়, দুর্বিনীত তাণ্ডব চলছে তার বুকে। নেত্রকোনার বিরিশিরির বটতলা মোড়ে সোমেশ্বরীর পাড়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে এর ক্ষতবিক্ষত চেহারা।

ইজারা নিয়ে নদী থেকে বালু তুলছে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই। কিন্তু মানা হচ্ছে না ইজারার শর্ত। এককালের চোখজুড়ানো এই নদী রক্ষায় কারও কোনো কার্যকর উদ্যোগও নেই।

শত শত ‘বাংলা ড্রেজারের’ (অননুমোদিত ড্রেজার) কানফাটানো বিকট শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে নদীর দুই পাশের প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার এলাকায়। দূষিত পরিবেশ। দুর্বিষহ পরিস্থিতি। ক্ষতবিক্ষত সোমেশ্বরীর পাড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে কানে প্রায় তালা লেগে যায়। নদীর বুক খুঁড়ে প্রতিদিন তুলে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার ট্রাক বালু, নুড়ি পাথর আর কয়লা।

নদী থেকে যেসব যন্ত্র দিয়ে এবং যেভাবে বালু তোলা হচ্ছে, তা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের তৎপরতায় যাঁরা যুক্ত আছেন, তাঁদের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। যে কারণে সরকারি সংস্থাগুলোর সামনে বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের নদী হত্যা চলতে পারছে।
মুজিবর রহমান হাওলাদার, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন

বালু তোলার শ্রমিক, ট্রাকচালক আর ইজারাদারের তদারকিতে নিয়োজিত লোকেরা ছাড়া অন্যদের নদীর আশপাশে তেমন দেখা যায় না। সোমেশ্বরীর সৌন্দর্য দেখতে বেড়াতে আসেন না কেউ আর। যে সোমেশ্বরীর পাড় একসময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত, তার পাড় এখন পাহারা দেয় বালুদস্যুদের নিয়োজিত বিশেষ বাহিনী।

এক যে ছিল পাহাড়ি স্রোতস্বিনী

সোমেশ্বরীর খ্যাতি ছিল তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বিরল প্রজাতির মহাশোল মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর জন্য। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ে জন্ম সোমেশ্বরীর। উত্তর ও পূর্ব দিকে দূরে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে চলে গেছে গারো পাহাড়ের সারি। নিরিবিলি পাহাড়ি প্রকৃতির কোলজুড়ে এককালে ছুটে যেত স্বচ্ছ সলিলা সোমেশ্বরী।  

গারো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রবল বেগে নেমে এসে সোমেশ্বরী বাংলাদেশের সমতলে  প্রবেশ করেছে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায়। দুর্গাপুর থেকে হয়ে জারিয়া, বাঞ্জাইল বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে কংস নদে।

অবৈধভাবে বালু তোলার যেন উৎব চলছে। নষ্ট হয়ে গেছে সোমেশ্বরী নদীর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

স্থানীয় জেলেদের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল সোমেশ্বরীতে মাছ ধরা। তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক পর্যটক আসত। পর্যটনও আয়ের একটি অন্যতম উৎস ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের। পাহাড় থেকে নেমে আসায় সোমেশ্বরীর খরস্রোত বহু শতবর্ষ ধরে বয়ে আনত বালু আর নুড়িপাথর। এই বালু আর পাথরই নদীটির কাল হলো অবশেষে।

গত বুধবার দুর্গাপুরের বাবুইপাড়ার মাঝি নয়ন মিয়া তাঁর ডিঙি নিয়ে অপেক্ষা করছিল বিজিবির ঘাটে। কোনো যাত্রী নেই। নয়ন বলছিলেন, লোকজন এখন আর এদিকে আসেন না। বেশির ভাগ দিনমজুরি করেন।

নদী নয়, কেবলই বালুমহাল

সরকার সোমেশ্বরী নদীকে বালুমহাল পরিচিতি দিয়েছে। নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০৫ সালে। কালক্রমে বালুদস্যুরা ড্রেজিংকে নদী লুটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।

গত বুধবার দুর্গাপুর থেকে সোমেশ্বরীর বাংলাদেশের প্রবেশমুখ পর্যন্ত ঘুরে যে দৃশ্য দেখা গেল, লিখে তার বাস্তবতা প্রকাশ করা কঠিন। ইজারা দেওয়া পাঁচটি বালুমহালের আয়তন প্রায় দুই হাজার একর। নদীর প্রায় ২২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেখা গেছে বালু পরিবহন ও বালু তুলে নদীকে নিঃশেষ করে বিপুল তৎপরতা।

সোমেশ্বরী নদী থেকে প্রতিদিন ২১ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে। দিনে বালু পরিবহন করা হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ট্রাকে। দিন–রাত উচ্চ শব্দে বহু মানুষের সমস্যা দেখা দিয়েছে শ্রবণে।

দুর্গাপুরের শ্যামগঞ্জ থেকে পথের দুই ধারে খানিক পরপরই চোখে পড়ে টিলার মতো বালুর স্তূপ। এসব বালু বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয় ট্রাকে করে। কোথাও কোথাও বিশেষ ধরনের যন্ত্রে বালু থেকে নুড়িপাথর আর কয়লা আলাদা করা হচ্ছে। যন্ত্রের ঘর্ঘর শব্দ আর ট্রাকের আওয়াজ খনখন করে দিচ্ছে গ্রামীণ পরিবেশের নীরবতা।

সোমেশ্বরী নদী থেকে বালু ও পাথর তুলে ট্রাকে ভরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

নদী থেকে ‘বালু তোলা’ শব্দটির বদলে ‘বালু লুট’ কথাটিই বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই। সেই দৃশ্য চোখে পড়ল বিরিশিরি সেতুর ওপরে দাঁড়িয়ে। উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে যাওয়া সোমেশ্বরীর চওড়া বুকে প্রবাহ এখন সরু খালের মতো। পুরো নদীতে শত শত বাংলা ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু তোলা। বাঁশের খুঁটির ওপরে মাচান বেঁধে বসানো হয়েছে শ্যালো মেশিন আর ছাঁকার যন্ত্র। নদী থেকে বালু উঠিয়ে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। শত শত বাংলা ড্রেজার বসানো হয়েছে। প্রতিটি ড্রেজার প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ টন বালু ও পাথর তুলতে পারে। সারা দিন সারা রাত অবিরত চলছে এই কাজ।  

অতিরিক্ত ওজন ও ভেজা বালু বহনে প্রতিদিন প্রায় প্রতিদিন দুই হাজার ট্রাক চলছে। ফলে ভেঙে গেছে ৩১৬ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কে সড়ক।

ড্রেজার বসানোর জন্য ফেলা রাখা হয়েছে অসংখ্য বাঁশ। ড্রেজারগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিতে নতুন করে খুঁটি পোতার জন্য এসব বাঁশ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এগুলো পরে আর সরানো হয় না। বাঁশগুলো নদীতেই থেকে যায়, যা পরে নৌচলাচল ও মাছ ধরার জন্য জাল পাতার ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্ট করছে বলে জানালেন দেবথৈল গ্রামের বাসিন্দা হারুন সাংমাসহ অনেকে। এ ছাড়া ড্রেজারের তেল গিয়ে মেশে নদীর পানিতে। তাতে দূষিত হচ্ছে পানি।  

‘বোবা–কালা’ হয়ে থাকা

নদীতে বালু তোলার তাণ্ডব উত্তরে নদীর শেষ সীমা ফারংপাড়া হয়ে দেশের শেষ সীমা ‘বটতলা’ পর্যন্ত। এরপরই গারো পাহাড়ের ওপর দিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কাঁটাতারের বেড়া। ড্রেজারের বিকট শব্দে চারপাশের যেন নরক গুলজার হয়ে আছে। নদীর পাড়ে গেলে পাশের জনের সঙ্গেও কথা বলতে হয় চিৎকার করে। পেশায় দরজি দুর্গাপুরের শিবগঞ্জের বাসিন্দা মোহাম্মদ রায়হান বললেন, ড্রেজারের শব্দের রাতে তাঁদের ভালো করে ঘুম হয় না। ‘প্রতিবাদ করেন না কেন?’ জিজ্ঞাসা করতেই তীব্র ক্ষোভে  বললেন, ‘কার কাছে প্রতিবাদ করব। কেউ কিছু বলতে গেলেই ইজারাদারের লোকেরা পুলিশ নিয়ে এসে বেঁধে থানায় নিয়ে যাবে। ভয়ে কেউ কিছু বলে না। সবার মুখে তালা।’

দিন–রাত উচ্চ শব্দে বহু মানুষের সমস্যা দেখা দিয়েছে শ্রবণে। বলা যেতে পারে, সোমেশ্বরীর পাশের মানুষেরা ‘বোবা–কালা’ হয়ে অমানবিক পরিবেশে জীবনধারণ করছেন।

মৃতপ্রায় সোমেশ্বরী নদীর মধ্যে দিয়ে চলছে বালু ভর্তি ট্রাক
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেত্রকোনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অননুমোদিত “বাংলা ড্রেজার” দিয়ে বালু তোলায় নদীটি অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে, পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। তাদের কাছে সঠিক জরিপ নেই, তবে আনুমানিক প্রতিদিন ২১ লাখ ঘনফুট বালু ও পাথর তোলা হচ্ছে। নিয়ম অনুসারে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করে সুইং ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা উচিত। আমরা বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পুরো নদীর ওপর সমীক্ষা করে প্রকল্প তৈরির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দিয়েছি।’

ইজারা পান শাসক দলের লোকেরা

বরাবরই শাসক দলের লোকেরাই বালুমহালগুলোর ইজারা পেয়ে আসছেন। এবার সোমেশ্বরী নদীর প্রায় ১ হাজার ৯১৪ দশমিক ৩৪ একর জায়গাজুড়ে পাঁচটি বালুমহাল ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হয়েছে। ভবানীপুর এলাকা থেকে দুর্গাপুর শ্মশানঘাট, শ্মশান ঘাট থেকে চৈতাটি ঘাট, দুর্গাপুরের বিরিশিরি সেতু থেকে কেরনখোলা বাজার, চৈতাটি ঘাট থেকে গাওকান্দিয়া, বাঞ্জাইল থেকে উত্তর শংকরপুর—এই পাঁচটি বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে।

কিছু বালু হয়তো তোলা প্রয়োজন। কিন্তু নদীকে হত্যা করে, পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নদীর নাব্যতা ঠিক রাখতে যতটা প্রয়োজন, ততটুকু বালুই উত্তোলন করতে হবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বেলা

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এবার প্রায় ৭৭ কোটি টাকায় এই পাঁচটি বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে। সব কটিই পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা। এর মধ্যে চারটি বালুমহাল ইজারা পেয়েছেন নেত্রকোনা-১ (কলমাকান্দা-দুর্গাপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাক আহম্মেদ ওরফে রুহী। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রুহী এন্টারপ্রাইজের নামে ৭৪ কোটি টাকায় তিনি এই চারটি বালুমহালের ইজারা পেয়েছেন। বাকি বালুমহালের ইজারা পেয়েছেন বিরিশিরি ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলামের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভাব হয়নি। তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

মোস্তাক আহমেদ মেয়ের চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাত্র পাঁচ মাস আগে তিনি বালুমহালের ইজারা পেয়েছেন। নদীর ক্ষতি আগেই হয়েছে। তিনি বরং নদীকে রক্ষা করে বালু তোলার কাজ করছেন। বালু তোলার কাজে অনেক পরিবর্তন এনেছেন। বালুমহালে সিসি টিভি বসানো হয়েছে।

অবৈধ ‘বাংলা ড্রেজার’ ব্যবহার সম্পর্কে মোস্তাক আহমেদ বলেন, জিরো পয়েন্ট থেকে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে চর পড়েছে। এখানে সুইং ড্রেজার যেতে পারে না। প্রায় ১০০ বছর ধরে এখানে চর পড়েছে। যাঁরা ইজারা পাননি, তাঁরাসহ স্থানীয় কিছু রাজনীতিক, চোরাকারবারি তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

প্রায় ২ বছর আগে স্থাপন করা হয় যানবাহনের ওজন মাপার যন্ত্রটি। অজানা কারণে তা চালু হয়নি এখনো
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

৩১৬ কোটির সড়ক চুরমার বালুর ট্রাকে

নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান জানান, প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার ট্রাক শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কে চলছে বালু আনা–নেওয়ার কাজে।

গত বুধবার দেখা গেল, শ্যামগঞ্জ বাজার থেকে বিরিশিরি পর্যন্ত ৩৭ কিলোমিটার পুরোটাই দখল করে থাকে এই বালুর ট্রাকগুলো। কৃষ্ণচর বাজার থেকে দুর্গাপুর পৌর এলাকা পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। মাত্র বছর তিনেক আগে ৩১৬ কোটি টাকা খরচ করে এই সড়ক তৈরি করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এখন সড়কটিকে মনে হয় লাঙল দেওয়া জমি।

আরও পড়ুন

সড়কে দুটি গাড়ি কোনোমতে পাশাপাশি যেতে পারে। বালু বহনের বিশালাকার অনেক ট্রাকের নিবন্ধন নম্বর পর্যন্ত নেই। ট্রাকের মালামাল রাখার অংশের দুই পাশে তক্তা জুড়ে দিয়ে এগুলো আরও উঁচু করে স্বাভাবিক ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণের ভেজা বালু নেওয়া হয়। পথের পাশে কিছু দূর পর পর সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ট্রাকে ভেজা বালু ও অতিরিক্ত ওজন পরিবহন নিষিদ্ধ। কিন্তু দেখভালের কেউ নেই। ট্রাকে মালামাল ওজনের জন্য জারিয়া আনসার ক্যাম্পের সামনে বছর দুয়েক আগে ওজন মাপার কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। অথচ এটি চালু করা হয়নি।

ইজারা দেওয়া পাঁচটি বালুমহালের আয়তন প্রায় দুই হাজার একর। নদীর প্রায় ২২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেখা গেছে বালু পরিবহন ও বালু তুলে নদীকে নিঃশেষ করে বিপুল তৎপরতা।

বিপুল ওজনের বালু বহন করায় ট্রাকগুলো চলছে ধীরগতিতে। যানজট লেগেই আছে। আর ছোট–বড় দুর্ঘটনাও ঘটছে। চলতি বছর জুনেই বালুবাহী ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছেন দুজন। ৮ জুন টাঙ্গাইলের করোটিয়ার সা’দত কলেজের শিক্ষার্থী শাহ আলম আর গত ১৫ জুন নিহত হন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফরিদউজ্জামান। এ বছর অক্টোবর পর্যন্ত ট্রাকচাপায় ১৫ জন নিহত হয়েছেন।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নেত্রকোনার নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আল নূর সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত ওজন ও ভেজা বালু পরিবহনের কারণে নবনির্মিত শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কটি বহু জায়গা ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ভাঙা অংশ মেরামত করতে এখন প্রতি কিলোমিটারে এক কোটি টাকার বেশি খরচ হচ্ছে।

বন্ধ হয়ে গেছে আত্রাখালীর মুখ

বিরিশিরি সেতু পার হয়ে এগিয়ে গেলে আরেকটি বড় সেতু দুর্গাপুরের আত্রাখালী নদীর ওপরে। আত্রাখালী সোমেশ্বরীর শাখা। দেখা গেল, সোমেশ্বরী থেকে বালুর ট্রাক চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এ জন্য বালু ফেলে সেতুর কাছে আত্রাখালীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে সোমেশ্বরী থেকে আত্রাখালীতে পানি আসার কোনো পথ নেই। আত্রাখালী পরিণত হয়েছে বালুচরে। কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানি জমে ডোবার মতো হয়ে আছে। নদীটির অপমৃত্যু ঘটেছে বালুদস্যুদের কবলে পড়ে।  

আত্রাখালী নদীর মুখ আটকে বালুর ট্রাক চলাচলের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। তাই সোমেশ্বরী নদীর পানি আত্রাখালীতে প্রবেশ করতে পারছে না
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জেলায় নতুন এসেছেন। সোমেশ্বরী নদীকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তা তিনি ভাবছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অননুমোদিত ড্রেজার ও ভেজা বালু পরিবহন বন্ধ করাসহ জনদুর্ভোগ বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর ইজারাদারদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ পালন করা হচ্ছে কি না, তা দেখতে অভিযান চালানো হবে। জেলা প্রশাসক বলেন, ওজন পরিমাপক যন্ত্রটি ব্যবহারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে এটি চালু করা হবে।

আরও পড়ুন

জেলা প্রশাসক এটাও বললেন, উজান থেকে প্রচুর বালু আসে নদীর স্রোতে। বালু না তোলা হলে নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে ভরাট হয়ে যাবে। নদী রক্ষার জন্যই বালু তোলা প্রয়োজন। সে কারণেই বালুমহালের ইজারা দেওয়া হয়েছে। যাঁরা বেশি দর দিয়েছেন, নিয়ম মেনে তাঁদেরই ইজারা দেওয়া হয়েছে। তবে ইজারাদারেরা নিয়মবহির্ভূতভাবে বালু তুলে নদী ও পরিবেশ বিনষ্ট করবেন, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা ও তদারকি করা হয়। অনিয়মের জন্য জরিমানা করা হয়। এটা চলতে থাকবে।

সোমেশ্বরী থেকে তোলা বালু ও পাথর নিয়ে চলছে সারি সারি ট্রাক
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে

সোমেশ্বরীর চিত্র দেখলে অবশ্য প্রশাসনের আদৌ তেমন কোনো নজর আছে কি না, তা বোঝা যায় না।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার মনে করেন, নদী থেকে যেসব যন্ত্র দিয়ে এবং যেভাবে বালু তোলা হচ্ছে, তা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের তৎপরতায় যাঁরা যুক্ত আছেন, তাঁদের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। যে কারণে সরকারি সংস্থাগুলোর সামনে বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের নদী হত্যা চলতে পারছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলাকে বলেন, সোমেশ্বরী এখন আর নদী নেই, ক্ষীণ একটা জলধারা। লুট হয়ে যাচ্ছে নদী। সবখানে অননুমোদিত বাংলা ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। অবিলম্বে বালু তোলা ইজারা বন্ধ করতে হবে। নদীকে রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব, বালু ব্যবসায়ীদের নয়। অন্তত তিন-চার বছর বালু তোলা বন্ধ রেখে নদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। মহাশোল মাছের বাসস্থানে পরিণত করতে হবে।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এই নদীতে অনেক বালু আসে। কিছু বালু হয়তো তোলা প্রয়োজন। কিন্তু নদীকে হত্যা করে, পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নদীর নাব্যতা ঠিক রাখতে যতটা প্রয়োজন, ততটুকু বালুই উত্তোলন করতে হবে। সে জন্য বিশেষজ্ঞদের দিয়ে জরিপ করে বিজ্ঞানসম্মত ড্রেজার দিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বালু তোলা যেতে পারে।

আরও পড়ুন